নগরজীবনেও প্রবীণদের কথা ভাবুন

আজ ১ অক্টোবর, ২৫তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘের আহ্বানে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর প্রবীণ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য Sustainability and Age Inclusiveness in the Urban Environment. অর্থাৎ, নগর পরিবেশে প্রবীণদের অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিত করুন। অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে প্রবীণ জনসহ সমাজের সব বয়সীদের নিয়ে সুন্দর নগরজীবন সুনিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের এই উদাত্ত আহ্বান। আজকের প্রবীণেরাই আমাদের জন্ম দিয়েছেন, প্রতিপালন করে বড় করেছেন আর গড়ে তুলেছেন এই আধুনিক সমাজ, নগর-সংস্কৃতি আর সভ্যতা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রবীণ ব্যক্তিরা ক্রমবর্ধমান হারে অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। বার্ধক্যের হাত থেকে বাঁচার কোনো সাধ্য না থাকার পরও নিজের বার্ধক্য সম্পর্কে কেউ যেন জানতে চান না, মানতে চান না, ভাবতে চান না! পাশাপাশি, প্রবীণদের কেউ দেখতে চান না, বুঝতে চান না, কাছে যেতে চান না, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান না, প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করতে বা টাকাপয়সা খরচ করতে আগ্রহী হন না; উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাঁদের অধিকার সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকেন!

>বর্তমানে বাংলাদেশে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ বছর আর গড় আয়ু ৭০ বছর। মাঝখানের এই ১০-১১ বছর দেশের অত্যন্ত মেধাবী, জ্ঞান-দক্ষতা-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কর্মতৎপরতা আর অবদান হতে জাতি বঞ্চিত হচ্ছে!

বাংলাদেশের পল্লি অঞ্চলের তুলনায় শহরবাসী প্রবীণদের অবস্থা বেশি নাজুক। নগর জনপদে প্রবীণদের পক্ষে যানবাহনে চড়া, অফিস-আদালত-ব্যাংক-হাসপাতালে যাওয়া-আসা, হাঁটাচলা করা, রাস্তা পার হওয়া, বাজারঘাট ও দৈনন্দিন কাজকর্ম করা অত্যন্ত কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। প্রবীণদের প্রাপ্য অধিকার, চাহিদা ও সামর্থ্যের কথা কেউ গুরুত্ব দেয় না বলেই শহরের স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে প্রবীণদের জীবন চলার সম্পূর্ণ বিপক্ষে!
বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ, ২০২৫ সালে হবে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ, ২০৫০ সালে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০৬১ সাল নাগাদ হবে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ! আবার প্রবীণ জনসংখ্যার মধ্যে অতি প্রবীণদের (৮০+) বৃদ্ধির হার মধ্যম-প্রবীণ (৭০-৮০ বছর) এবং তরুণ-প্রবীণদের (৬০-৭০ বছর) চেয়ে দ্রুততর! ২০৫০ সালে এ দেশের শিশু ও প্রবীণের অনুপাত হবে মোট জনসংখ্যার ১৯: ২০ শতাংশ! সংখ্যায় প্রবীণেরা দ্রুত বাড়ছেন তাই নয়; এঁদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মতো পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সক্ষমতা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা-প্রযুক্তি, জীবন-সচেতনতা এবং যাতায়াত-যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল অনেক বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। ১৯২১ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল যেখানে ছিল মাত্র ২০ বছর; বর্তমানে তা ৭০ ছাড়িয়ে গেছে! জীবনের সঙ্গে আমরা অতিরিক্ত বছর যোগ করতে পেরেছি, কিন্তু বাড়তি বছরগুলোতে জীবন যোগ করতে পারিনি! তবে বিজ্ঞানীরা বার্ধক্য জয়ের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ নাগরিক সমাজের নেতৃত্বে প্রবীণদের উপস্থিতি, ভূমিকা এবং অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবাই আজ প্রবীণ। প্রবীণদের স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা, আত্মতৃপ্তি, সেবাযত্ন ও দেখভালের বিষয়টি আজ খুবই ঝুঁকির সম্মুখীন। সচ্ছল প্রবীণদের পরিচর্যার জন্য পারিবারিক, সনাতনী, পেশাদার অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারী ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ বছর আর গড় আয়ু ৭০ বছর ছাড়িয়েছে। মাঝখানের এই ১০-১১ বছর দেশের অত্যন্ত মেধাবী, জ্ঞান-দক্ষতা-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কর্মতৎপরতা আর অবদান হতে জাতি বঞ্চিত হচ্ছে! তাহলে বাধ্যতামূলক অবসরব্যবস্থা কি মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়?
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি ও সরকার যথেষ্ট প্রবীণবান্ধব। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ প্রবর্তিত পেনশন-ব্যবস্থার ৭২ বছর পরে প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনার দূরদর্শী উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে চালু করা হয়েছে বিশ্বনন্দিত বয়স্কভাতা কর্মসূচি; অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯/৬০ বছর করা হয়েছে; অনুমোদিত হয়েছে বহু প্রতীক্ষিত ‘প্রবীণবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা, ২০১৩’ এবং ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩’। পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের দেশব্যাপী প্রবীণ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার বার্ষিক বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রবীণবান্ধব সরকারের দূরদর্শী চিন্তার ফলশ্রুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সম্প্রতি চালু করা হয়েছে ‘বার্ধক্য ও প্রবীণকল্যাণ’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম।
সম্মানিত প্রবীণদের অধিকারের দিকটি ভেবে এবং সবার বার্ধক্যের কথা মাথায় রেখে জাতিসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে আজকের এই দিনে আসুন নবীন-প্রবীণ সবাই মিলে বাংলাদেশের প্রতিটি শহর-নগর গঠন-পুনর্গঠন করি। শহর-বন্দরে স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য এবং তৃপ্তির সঙ্গে প্রবীণদের বসবাসের ব্যবস্থা যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তবে নগরজীবনে একদিন আমাদের বার্ধক্যও হবে সফল, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ। আসুন শপথ নিই, নগরজীবন থেকে প্রবীণদের বিচ্ছিন্ন করব না। তাঁদের নিয়ে সবাই মিলে আমরা এই দেশকে করব সব বয়সীর জন্য সমান সুরক্ষিত এবং উপভোগ্য এক অনিন্দ্য সুন্দর বাংলাদেশ।
অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান: সমাজকল্যাণ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ।
[email protected]