কাজে জিরো টলারেন্সের প্রতিফলন দেখছি না

>

মুনিরুজ্জামান
মুনিরুজ্জামান

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের সফর স্থগিত এবং ইতালির নাগরিক হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি ফের জনগণকে উদ্বিগ্ন করেছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্ডিয়ান-এ সাক্ষাৎকার দিয়ে ব্রিটিশ জিহাদিদের ব্যাপারেও সতর্ক করেছিলেন। সম্প্রতি ব্যাংককে মন্দিরে হামলার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত চীনা নাগরিক আইজান বাংলাদেশেও এসেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো
মুনিরুজ্জামান, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক

প্রথম আলো: অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা অ্যালার্টকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

মুনিরুজ্জামান: পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সময় সময়ে তাদের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ সতর্কীকরণ হালনাগাদ করে থাকে। কী কারণে অস্ট্রেলিয়া তার টিমের সফর স্থগিত করেছে, তা তারা প্রকাশ্যে না বললেও বাংলাদেশ সরকারকে জানাতে পারে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিদেশি নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পরপর কয়েকজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। এর একটিরও সুরাহা হয়নি। কোনো ঘাতকের বিচার শুরু করা যায়নি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের একটা যোগসূত্র স্থাপন হয়ে গেছে। ব্যাংককে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ঢাকায় দুই সপ্তাহ নিরাপদে থেকে গেলেন। গত ১৩ আগস্ট হায়দরাবাদে যে বেশ কিছু জঙ্গি ধরা পড়েছিল, সেখানে বাংলাদেশ হুজির দুজন সদস্যেরও সন্ধান মিলেছে। তারা ভারতে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল। সরকার এত দিন বলে আসছিল যে জঙ্গিদের ব্যাপারে তাদের জিরো টলারেন্স, কিন্তু সে জন্য যে রকমের পরিবেশ বিরাজ থাকার কথা, তা দেখা যাচ্ছে না।

প্রথম আলো: এসবের বাইরে কি নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে?

মুনিরুজ্জামান: আমরা সব সময় বলে এসেছি, বাংলাদেশ কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে না। কিন্তু সেখানে দেখা যাচ্ছে, মাঠপর্যায়ে যে ধরনের দক্ষতা থাকা দরকার, সেখানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আরাকান লিবারেশন আর্মির যে ঘাঁটির কথা সম্প্রতি জানা গেছে, তা কোনো অস্থায়ী ঘাঁটি বলে মনে হচ্ছে না। মোটামুটি সেখানে তারা শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি যদি কার্যকর থাকবে, তাহলে আরাকান আর্মির একটি গ্যারিসনধর্মী ঘাঁটির সন্ধান পাওয়ার কথা নয়। সুতরাং কোথাও একটা শৈথিল্য ঘটেছে। আইএস যে বাংলাদেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে তা পরিষ্কার। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের বেশ কয়েকজন তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যে যোগসূত্র, তা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রথম আলো: কিন্তু গার্ডিয়ান বলেছে, মাত্র ৩০ জন যোগ দিয়েছে। এই সংখ্যাটিকে অনেকে খুব গুরুত্ব দিতে চান না।

মুনিরুজ্জামান: অনেক দেশ থেকে যেভাবে শয়ে শয়ে গেছে সে তুলনায় কম, তা সত্য। কিন্তু প্রবণতা উদ্বেগজনক।

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেভিড ক্যামেরনকে সতর্ক করেছেন যে ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা হতে পারে।

মুনিরুজ্জামান: এ রকম পরিস্থিতিতে বিদেশি সরকারপ্রধানকে পরামর্শ প্রদান ও সহযোগিতা আশা করা অযৌক্তিক নয়। যেহেতু ব্রিটেন থেকে আইএসের জন্য নিয়োগকারীর ঢাকায় আসার খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাই প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাওয়াটা সংগত। তবে ব্রিটেনকে বললেই হবে না, অন্য যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সন্ত্রাসীরা জড়িয়ে পড়ছে, তাদেরও বলতে হবে।

প্রথম আলো: একসময় আমাদের মিডিয়ায় পাকিস্তানের আইএসআই নিয়ে লেখালেখি হতো। তারা কি হারিয়ে গেছে?

মুনিরুজ্জামান: এখন দৃশ্যত আইএসআইয়ের কোনো বড় পদচিহ্ন এখানে দেখা যাচ্ছে না। তারা হয়তো কিছুটা গুটিয়ে ফেলেছে অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যে সীমান্ত অঞ্চলটি আছে, সেখানে সঠিক নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রে রাখা যাচ্ছে না। সেখানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম আলো: আপনি গত দুই সপ্তাহ ওয়াশিংটনে অবস্থানকালে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়া বা বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের বর্তমান মনোভাব কেমন?

মুনিরুজ্জামান: তাঁরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁদের কাছে প্রধান বিষয় হচ্ছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা উদ্বিগ্ন রয়েছেন। বাংলাদেশ সীমান্তে যে পরিস্থিতি, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এবং বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নিয়ে, সে বিষয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। আমাদের ইনস্টিটিউটের দিক থেকে আমরা একটা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছি যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যে ধরনের অস্থিরতা রয়েছে, তা যদি চলতে থাকে, তাহলে একসময় আইএস এই সুযোগটা গ্রহণ করতে পারে। আইএস প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে চেচনিয়ায় একজন আইএস গভর্নর নিয়োগ করেছে। তারা বলেছে, বিশ্বের যেখানেই মুসলমানদের ওপর এ রকমের অত্যাচার হবে, সেখানেই তারা তাদের ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা চালাবে। সেদিক থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার যে সমাধান করতে পারছি না, সেটাকে কাজে লাগিয়ে আইএস এখানে প্রভাব বিস্তারের জন্য আসতে পারে। তাই এখন আমাদের যেটা দরকার, যে সমস্যাগুলো বর্তমানে রয়েছে তা বিশ্লেষণ করা। যে অবস্থা আমরা সামগ্রিকভাবে দেখতে পাচ্ছি, তাকে এখন একটি ক্যানভাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

অস্ট্রেলিয়া উল্লেখ করেছে যে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের পুলিশ ও র‍্যাব বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের ধরছে এবং জনসমক্ষে তাদের প্রদর্শন করছে। মিডিয়ায় আমরা প্রায়ই দেখছি, চার-পাঁচজনকে ধরা হচ্ছে এবং বুকে নাম লিখে ক্যামেরার সামনে প্রদর্শন করা হচ্ছে। তাহলে স্থিতিশীলতার যে রূপ থাকা দরকার, সে রূপটা তো আমরাই দিতে পারছি না। কারণ, আমরা নিজেরাই বলছি যে তারা ধরা পড়ছে, তাহলে প্রমাণিত হচ্ছে যে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। এই তথ্য তারা দিচ্ছে না, আমরা দিচ্ছি।

প্রথম আলো: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন প্রশাসন দক্ষিণ এশিয়া থেকে খবর পাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমা স্বার্থের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। এতে কোনো নতুনত্ব আছে বলে মনে হয়?

মুনিরুজ্জামান: এখানে তারা পরিবর্তন এনেছে। নিরাপত্তা অ্যালার্টকে তারা উচ্চমাত্রায় নিয়েছে। আমরাই তো জঙ্গি চিত্র তুলে ধরছি।

প্রথম আলো: আমাদের না হয় অদক্ষতা রয়েছে, কিন্তু তারা কিসের ভিত্তিতে আশঙ্কা প্রকাশ করছে? কেউ কেউ শঙ্কিত যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভিন্ন খাতে নেওয়ার কোনো চেষ্টা আছে কি না।

মুনিরুজ্জামান: পশ্চিমা বিশ্বে এ ধরনের অবস্থান টিভি ফুটেজ দেখে হয় না। তাদের নিজেদের গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। এটা হালকাভাবে করা হয় না। কাজেই তাদের কাছে কী তথ্য আছে, সেটা জানতে সরকার উদ্যোগী হতে পারে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং চাইলে সেটা তাদের পাওয়ার কথা।

প্রথম আলো: জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য আপনি রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করছেন?

মুনিরুজ্জামান: বাংলাদেশের যে অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ, তা যদি আমরা দ্রুত ঠিক না করতে পারি, তাহলে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও বিস্তার লাভ করবে। বাংলাদেশে আমরা একটা বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছি। যেখানে কোনো মতাদর্শগত বা বিরোধীদলীয় মত প্রকাশ মিলিয়ে যাচ্ছে, সেই ধরনের পরিবেশে জঙ্গিবাদের অনুকূল ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। যতক্ষণ আমরা সর্বজনীন রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে না যেতে পারব, ততক্ষণ এই সমস্যার মধ্যে থাকব।

প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাস দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো তফাত দেখতে পান কি না? তারা কি উভয়ে একই নিরাপত্তা হুমকিগত বিশ্লেষণের জায়গা থেকে নিজেদের পরিচালিত করছে? ভারত কি নীরব?

মুনিরুজ্জামান: তারা এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করে। দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে তারা একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এই অঞ্চলের কৌশলগত অংশীদার মনে করছে। আর প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে প্রকাশ্য অবস্থান সব সময় শতভাগ অভিন্ন হয় না। যদিও ভারতের সহযোগিতা আছে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে, কিন্তু এসব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ নিজস্ব বিবেচনাপ্রসূত হয়ে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে দৃষ্টিভঙ্গির পরম্পরা খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া যায় না। সেটা অনেকটা তাদের নিজস্ব বা জাতীয় স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়ে থাকে।

প্রথম আলো: জার্মান বিশেষজ্ঞ ড. সিগফ্রিড দাবি করেছেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটি জঙ্গি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আপনি কি একমত?

মুনিরুজ্জামান: আমরা সেই স্তরে পৌঁছাইনি। একটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার প্রবণতা আছে, সেটা ঠিক।

মেজরজেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।