জয়ের পথে জয়ের রথে বাংলাদেশ

এবারের বিজয় দিবস বাংলাদেশের বিজয়ের ব্যাপারে আমাদের নতুন করে আশাবাদী করে তুলল
এবারের বিজয় দিবস বাংলাদেশের বিজয়ের ব্যাপারে আমাদের নতুন করে আশাবাদী করে তুলল

১৭ ডিসেম্বরের সকালটায় কী যে ভালো লাগছে! নারকেলের চিরল পাতায় শীত-সকালের নরম আলো, বারান্দায় শিউলি, পত্রিকার পাতাজুড়ে বিজয় দিবস পালনের কত রংদার ছবি আর খবর। বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন দিবস পালনের জন্য পোশাকের রংও সৃজন করে নিয়েছে—এ দেশের মানুষের সৃষ্টিশীলতা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো—বসন্তের রং বাসন্তী, পয়লা বৈশাখে টকটকে লাল কিংবা সাদা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে কালো কিংবা সাদা-কালো আর বিজয় কিংবা স্বাধীনতা দিবসে বন্যা বয়ে যায় লাল আর সবুজের। এতটুকুন একটা জমিনে ১৬ কোটি মানুষ ঠাসাঠাসি করে থাকি আমরা, সেখানে এত বড় একটা উপলক্ষ, দেশজুড়ে তা পালিত হচ্ছে বিপুলভাবে, তা শান্তিপূর্ণভাবে হতে পারছে কি না, সেটা কিন্তু একটা বড় উদ্বেগ।
লাখ লাখ মানুষ বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাচ্ছে—রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নক্ষত্রপ্রতিম তর্জনী থেকে নির্দেশ এসেছিল—‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা কিছু্ আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।...এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যেখানে ৪৪ বছর আগের ১৬ ডিসেম্বরের বিকেলে মাথা নিচু করে হাতের অস্ত্র, কোমরের বেল্ট ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে অজস্র মানুষের সমবেত কণ্ঠে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাওয়া হচ্ছে হাজার কণ্ঠে, অধুনালুপ্ত ছিটমহলবাসী এই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পালন করছে বিজয় দিবস, শতকণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে, বা নিজেদের মতো করে, লাখো মানুষ চলেছে সাভারে, জাতীয় স্মৃতিসৌধে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—তাঁরা সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন আমাদের ৩০ লাখ শহীদকে। প্যারেড স্কয়ারে কুচকাওয়াজ হচ্ছে, গ্রামেগঞ্জে, জনপদে জনপদে, মাঠে-ঘাটে, স্কুলে-কলেজে, জেলায় জেলায় কত অনুষ্ঠান। আর তাতে যোগ দিচ্ছে কোটি মানুষ। এত বড় উদ্যাপন, সেটা নিরাপদে-নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হতে পারবে তো!
এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে এসে যায়, অথবা স্বাভাবিকভাবে না এলেও আসে। এবারের বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে কতগুলো তাৎপর্যপূর্ণ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ভালো করছে, বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সে কথাই আবারও জানালেন এ দেশে এসে, বাংলাদেশ উন্নতি করছে তরতর করে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ মহাসমারোহে আরম্ভ করে দিয়ে প্রমাণ করেছে, আমরা পারি! এটা শুধু মানসিক শক্তির প্রমাণ নয়, আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণ। এটা শুধু আর্থিক সংগতির লক্ষণ নয়, মনের দৃঢ়তারও ফসল। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির।
এবারের বিজয় দিবসের পটভূমিতে আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা। এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া। পাকিস্তানের শাসকেরা আগাগোড়া একটা মিথ্যার বলয় সৃষ্টি করে রেখেছেন, উটপাখির মতো বালুতে, নাকি চতুষ্পদ প্রাণীর মতো কাদায় মুখ গুঁজে তারা অস্বীকার করে চলেছেন তাঁদের নিজেদের ভয়াবহতম পাপ, ১৯৭১ সালে কী অমানবিক নৃশংস গণহত্যা ও নারী নির্যাতনই তাঁরা করেছেন! তাদের মদ্যপ-লম্পট সামরিক কর্তারা আর মিথ্যাবাদী রাজনৈতিক নেতারা নিষ্ঠুরতা দিয়ে, নির্মমতা দিয়ে একটা নৃগোষ্ঠীকে স্তব্ধ করে দিতে গিয়ে ইতিহাসের ভয়াবহতম পাপগুলোর একটা সংঘটিত করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ডেইলি স্টারে জুলিয়ান ফ্রান্সিসের নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। জুলিয়ান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীদের ত্রাণকাজে অক্সফামের সমন্বয়কের কাজ করেছিলেন। জুলিয়ান তাঁর প্রবন্ধে হিসাব কষে দেখিয়েছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যার শিকার মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। তাঁর নিজের ভাষায়, Perhaps we will never know the accurate figure; it could easily be over three million. সম্ভবত আমরা কোনো দিনও জানব না আসল সংখ্যাটা, কিন্তু এটা সহজেই দাঁড়াবে ৩০ লাখেরও বেশি | (http://www.thedailystar.net/op-ed/it-important-remember-1971-187654)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রদের তুলে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল ২৫ মার্চের রাতে, বা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, সেই ভিডিওই তো গণহত্যার প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল শত শত, সেটাই তো গণহত্যা প্রমাণের জন্য যথেষ্টরও বেশি। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে এবং পাকিস্তানিদের লেখা বইপত্র, স্মৃতিকথায় পাকিস্তানি জেনারেলদের উক্তি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা জানতে চান, কতজন হিন্দুকে মারা হয়েছে! পূর্ব ফ্রন্টে থাকা সৈন্যরা কেন বলছে তাদের খাবারের অভাব, ওখানে কি মানুষের গরু-ছাগল সব শেষ হয়ে গেছে! কিংবা এক জেনারেল বিমানবন্দরে নেমেই বলেছেন, আমার জন্য কতজন মেয়েমানুষ তৈরি করে রেখেছ! পাকিস্তান ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েছে বাংলাদেশে, ১৯৭১ সালে, কোনো দিন মাফ চায়নি, দুঃখ প্রকাশ করেনি, এখন অফিশিয়ালি অস্বীকার করছে।
অন্যদিকে আমরা যখন ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা স্মরণ করি, কীভাবে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষদের তালিকা করা হয়েছিল, তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি প্রস্তুত করা হয়েছিল, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর মেরে ফেলে রাখা হয়েছিল জল-জংলায়, আমরা শিউরে উঠি। আমরা সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বাঙালি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখি, শাস্তি কার্যকর হতে দেখি। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের ভয় কাটে না। কারণ, এখনো একইভাবে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করা হয়, প্রকাশ করা হয়, মোবাইলে বা চিঠিতে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। লেখকদের হত্যা করা হচ্ছে, প্রকাশকদের হত্যা করা হচ্ছে। অর্থাৎ ৪৪ বছর পরেও পাকিস্তানি পিশাচদের আত্মা এখনো সক্রিয় আছে, তারা দেহের আকার পাচ্ছে এবং আক্রমণ চালাচ্ছে।
আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। ভারতের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের কতগুলো ছিটমহল, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে ছিল ভারতের কতগুলো ছিটমহল। যুগের পর যুগ ওই মানুষগুলো বন্দী হয়ে ছিলেন রাষ্ট্রগুলোর নিয়মের নিগড়ে। এবারই প্রথম তারা মুক্ত হলেন। বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ছিটমহলগুলোর মানুষেরা এবার বাংলাদেশি হিসেবে পালন করলেন বিজয় দিবস। রাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, আন্তর্জাতিক আইন—সবকিছুর একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, মানুষের মুক্তি, মানুষের কল্যাণ—আমরা নিশ্চয়ই এবার শ্লাঘা অনুভব করব যে সাবেক ছিটমহলের মানুষেরা এবার বিজয় দিবস পালন করছেন—৪৪ বছর পরে।
এমনি তাৎপর্যময় প্রেক্ষাপটে এবারের বিজয় দিবস পালিত হলো। বলা যায়, তা ঘটেছে নির্বিঘ্নে। দুটো ছোট নেতিবাচক খবর অবশ্য আছে। এক. চট্টগ্রামে ফুল দিতে গিয়ে শিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ। দুই. মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীকের বঙ্গভবনের ফটক থেকে ফিরে যাওয়া। তাঁকে যদি ঢুকতে নাই দেওয়া হবে, দাওয়াত না দিলেই হতো! আরেকটা ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আছে। রাজপথে বিএনপির ফিরে আসা। খালেদা জিয়া ফুল দিতে গেছেন জিয়াউর রহমানের সমাধিতে, বিএনপি শোভাযাত্রা করেছে, তাতে উপস্থিত ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আর রুহুল কবির রিজভী; কারামুক্ত নেতারা—দেখে ভালো লাগল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে, তিনি পাকিস্তানে খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, আওয়ামী লীগ হলো বিরোধী দল, কাজেই আওয়ামী লীগকে কাজ করতে দেওয়া উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি জামায়াতের সংস্রব ত্যাগ করে আত্মশক্তিতে দাঁড়াতে পারে, সেটা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য হবে বড় সুখবর। সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য জানালা চাই, তাদের সমবেত হওয়ার জন্য পরিসর চাই।
সবটা মিলিয়ে এবারের বিজয় দিবস বাংলাদেশের বিজয়ের ব্যাপারে আমাদের নতুন করে আশাবাদী করে তুলল। বিপিএলের
সফল সমাপ্তি, তাতে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের ভালো করার পাশাপাশি আরেকটা আশ্বাসও তো আছে, বিদেশি খেলোয়াড়দের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ। এর আগে বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর, স্কয়ার আয়োজিত লোকসংগীতের আসর, ঢাকা লিট ফেস্ট ইত্যাদি আন্তর্জাতিক আসরে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে, ৬০ হাজার মানুষ সারা রাত জেগে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনেছে—এই দেশ নিয়ে আশাবাদী না হয়ে আপনি পারবেন? পাশাপাশি স্বস্তিও বোধ করুন এই ভেবে যে একটা কুপিবাতি ওলটানোর মতো দুর্ঘটনাও তো ঘটেনি এইসব উৎসবে।
আসলে বাংলাদেশ শান্তির দেশ। শান্তিকামী মানুষের দেশ। গানের দেশ, প্রাণেরও দেশ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা মানুষের দেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছে, তারপর থেকে তার যাত্রা, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, বিজয়েরই দিকে। বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছে, বাংলাদেশ বিজয়ী হবেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।