খালেদা কেন শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের ওপর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাগ, ক্ষোভ ও হতাশা থাকার হাজারটা কারণ থাকতে পারে। তিনি তাঁর সেই রাগ, ক্ষোভ কিংবা হতাশার কথা জনগণকে জানাবেন, তাতে দোষের কিছু নেই। এমনকি তিনি সরকারের অন্যায়-অবিচারের কথা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরে আন্দোলনের জন্য ডাকও দিতে পারেন। আগের বার জনগণ তাঁর কথায় সাড়া না দিলেও ভবিষ্যতে যে দেবেন না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না।
কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কেন স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন? গত সোমবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘আজকে বলা হয় এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। (প্রথম আলো ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫)
শহীদের সংখ্যা নিয়ে কারা বিতর্ক করছেন? বিতর্ক করছেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলরা, বিতর্ক করছেন সেই দেশটির এক শ্রেণির লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক। বিশেষ করে সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশে দুই রাজনীতিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সরকার ও রাজনৈতিক মহল যেসব মন্তব্য করেছে, তা ছিল খুবই উসকানিমূলক। এর মাধ্যমে একাত্তরে পরাজিত শক্তি নিজেদের অপরাধ আড়াল করারই চেষ্টা করেনি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেও অস্বীকার করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছে।
কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন, যিনি তিন-তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দুবার জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন, তিনি কীভাবে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন? তাও বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে! আর এটি যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা প্রমাণিত হলো বিএনপির জোটের আরেক শরিক এলডিপি নেতা কর্নেল অলি আহমদের বক্তব্যে। তিনি দাবি করেছেন, যাঁরা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছেন, কেবল তাঁদেরই শহীদ বলা যেতে পারে। তাঁর কথা সত্য ধরে নিলে একাত্তরে শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ জি সি দেব, শহীদ জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমদসহ দেশের যে অসংখ্য শ্রেষ্ঠ সন্তান জীবন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করেছেন, তাঁদের কাউকে শহীদ বলা যাবে না। কেননা তাঁরা কেউ কর্নেল অলি আহমদের ভাষায় রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি।
অলি আহমদেরা সেনাবাহিনীর লোক। তাই তিনি অস্ত্র হাতে নেওয়াকেই একমাত্র যুদ্ধ মনে করেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে ১৯৪৮সাল থেকেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে রাজনীতির মাঠে যুদ্ধ করেছেন, ভাষার দাবি আদায়ে রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছেন, কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন, সেসব তাঁর কাছে কিছুই না। কিছুই নয় বায়ান্ন থেকে শুরু হওয়া স্বাধিকারের আন্দোলন কিংবা ঊনসত্তর-একাত্তরের গণ-অভ্যুত্থান।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা হাফিজউদ্দিন আহমদ বিবিসির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, খালেদা জিয়া শহীদের সংখ্যা নিয়ে নিজে কোনো মন্তব্য করেননি। বিতর্ক আছে—সেটিই শুধু উল্লেখ করেছেন মাত্র। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে এই বিতর্কের কথা উচ্চারণ করেননি। আর তিনি যে বললেন, আজকাল বলা হয়, এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। এর মাধ্যমে কি তিনি শহীদদের সম্পর্কে এক ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন না?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, সেটি মোটেই আজকাল বলা হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং পরবর্তী দলিলপত্রেই এই সংখ্যাটি উঠে এসেছে। খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য একাত্তরের প্রতিটি শহীদ পরিবারকেই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। এমনকি তিনি যে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে এই বক্তব্য দিয়েছেন, তিনি যদি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের মুখের ও মনের ভাষা পড়তেন, দেখতেন কতটা বেদনাহত হয়েছেন।
যে প্রশ্ন এত দিন পাকিস্তানিরা তুলেছে, যে সংশয় পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর মদদপুষ্ট গবেষকেরা প্রকাশ করছেন, সেই প্রশ্ন ও সংশয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির নেত্রীর মুখে একেবারেই শোভা পায় না।
অতএব, সেদিন মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত প্রশ্নটি খালেদা জিয়া তুলেছেন, সেটি আশা করি তিনি প্রত্যাহার করে নেবেন এবং শহীদ পরিবারের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করবেন। ভুল স্বীকারে লজ্জা নেই।