চিরঞ্জীব কমরেড মণি সিংহ

মণি সিংহ
মণি সিংহ

কমরেড মণি সিংহ ছিলেন আমাদের উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা, অন্যতম স্থপতি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সপিবি) প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ। মার্ক্সবাদী বিপ্লবী আদর্শই ছিল তাঁর জীবনাদর্শ। তাঁর জীবনসংগ্রাম ছিল মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য, এবং তার মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে মানবমুক্তির জন্য। ‘মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ’, তথা সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল তাঁর আমৃত্যু সংগ্রামী প্রয়াস। মানুষই ছিল তাঁর সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি সব সময় ‘বিপ্লবী মানবতাবাদের’ কথা প্রচার করতেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মানবপ্রেমকে বিপ্লবী ধারায় সমাজে সর্বজনীন করে তুলতেই পরিচালিত হয়েছিল তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড।
কমরেড মণি সিংহকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ১৯৬৬ সালের মে মাসের এক সন্ধ্যায় ঢাকার কল্যাণপুর এলাকায় একটি বাঁশের বেড়ায় ঘেরা টিনের বাসায় অনুষ্ঠিত সন্ধ্যারাতের ছাত্রকর্মীদের বৈঠকে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ অবস্থায় আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থায় কাজ করছে। আমরা কলেজে প্রবেশ করে পার্টির কর্মী গ্রুপে গোপনে সংগঠিত হয়েছি। পার্টির ঢাকার ছাত্রকর্মীদের একটি সভা করে তাদের সামনে আত্মগোপনে থাকা পার্টি নেতাদের এনে তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক শক্তি সংহত করার জন্য মহান মে দিবস উপলক্ষে সন্ধ্যার পর সেই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। দেখলাম, সভাস্থলে উপস্থিত হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ জন ছাত্র কমরেড। আরও দেখলাম, হারিকেনের আলোয় আলোকিত সভাকক্ষের এক পাশ ধরে বসে আছেন তিনজন প্রবীণ ও একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ অপরিচিত ব্যক্তি। একে একে তাঁরা সবাই বক্তব্য দিলেন। কমরেড আজাদ (মণি সিংহ), কমরেড আমিন (অনীল মুখার্জি), কমরেড করিম (জ্ঞান চক্রবর্তী) ও কমরেড কবির (মোহাম্মদ ফরহাদ) নামে তাঁদের আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। সাদা পায়জামার ওপর সাদা ফুলহাতা লম্বা কুর্তা-শার্ট গায়ে ফরসা, লম্বা, কালো চশমা পরা কমরেড আজাদ নামের যে মানুষটির তেজোদীপ্ত বক্তব্য সেদিন শুনেছিলাম, তিনিই কমরেড মণি সিংহ। ১৯৬৮ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় মুক্ত হয়ে আসেন। তখনই তাঁর সঙ্গে আমার সামনাসামনি কথাবার্তা বলার প্রথম সুযোগ হয়। পরিচয় ঘনিষ্ঠতা লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমি ছিলাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রথম দলের একজন কমান্ডার। তিনি আমার কাছে অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধকৌশল, আমাদের গেরিলা দলগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জানতে চাইতেন।
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এবং কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, আন্তর্জাতিক, আদর্শিকসহ বহুবিধ কাজে সে সময়ের ৭০ বছর বয়সের এই মানুষটি নয় মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা সঠিক পথে প্রবাহিত করতে, তার প্রগতিমুখিনতা নিশ্চিত করতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশি-বিদেশি শক্তির সমাবেশ ও ঐক্য গড়ে তুলতে এবং জাতির এই মরণপণ সংগ্রামকে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে অমূল্য অবদান রেখেছেন।
স্বাধীনতার পর আরও অনেক কাছ থেকে কমরেড মণি সিংহকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। অগণিত সভায়, প্রকাশ্য-গোপন বৈঠকে, আন্ডারগ্রাউন্ডে, জেলা সফরে, জনসভায়, বিদেশ সফরে, পার্টির সমাবেশে, কৃষক সমিতি-খেতমজুর সমিতির কর্মসূচিতে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং একপর্যায়ে পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীতে তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগও আমার হয়েছে।
আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে অনেকগুলো মাস জেলখানায় একসঙ্গে একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি সিটে থাকার। আমার কারাজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল কমরেড মণি সিংহের নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়া। বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনবোধের নিখুঁত প্রতিফলন তাঁর মধ্যে তখন দেখেছি। শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রাত্যহিক জীবনাচরণ, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-বিনোদন, বন্দীদের প্রতি মমত্ববোধ, সাধারণ কয়েদিদের প্রতি প্রীতিময় আচরণ—এসব বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ছিল তখনকার ৭৫ বছর বয়সী মণি সিংহের কারাগারের দিনগুলো। এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি অধিকার ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর নিরন্তর লড়াই চালানোর ঘটনা। রেশন কেন খারাপ এল? পত্রিকা আসতে বিলম্ব হয় কেন? ডাক্তার রাউন্ডে থাকে না কেন? বন্দিজীবন, তাতে কী। কারাগারেও চলবে সংগ্রাম! ১৯৭৭ সালে এসবের মধ্যে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেছিলাম একজন প্রকৃত বিপ্লবীর অন্তরের অবিরাম সংগীত মূর্ছনার মর্মবাণী।
পাকিস্তানের শুরুর দিকে টঙ্ক আন্দোলনকে দমন-পীড়ন চালিয়ে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার পর নূরুল আমিনের সদম্ভ আস্ফালন ‘কমিউনিস্টদের এবার কবর দিয়ে দিলাম’ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে মণি সিংহ তাঁর ভাষণে প্রায়ই এ বিষয়ে উপসংহার টানতেন এই বলে, ‘কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। এই পার্টিকে যারা ধ্বংস করতে চাইবে, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। কমিউনিস্ট পার্টি জিন্দা আছে, জিন্দা থাকবে।’
কমরেড মণি সিংহ মার্ক্সবাদী পণ্ডিত ছিলেন না। কিন্তু তিনি মার্ক্সবাদকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি তাত্ত্বিক ছিলেন না, কিন্তু প্রজ্ঞার সঙ্গে তত্ত্ব প্রয়োগ করতে পারতেন। তাঁর জীবন পর্যালোচনা করে দেখতে পাই, বড় বড় মৌলিক ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সব সময়ই সঠিক অবস্থান নিয়েছেন। ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারা থেকে প্রথম সুযোগেই মার্ক্সবাদী জীবনাদর্শ গ্রহণ করা, শ্রমিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, নিজ জেলায় পারিবারিক আভিজাত্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক সশস্ত্র টঙ্ক আন্দোলন পরিচালনা, সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিভূমি রচনা করা, ‘মাওবাদের’ বিষয়ে সঠিক অবস্থান নিয়ে বামপন্থী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা, দক্ষিণপন্থী পদস্খলনের বিপদ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক হুঁশিয়ারি দেওয়া, পার্টিতে বিভেদের বিরুদ্ধে সব সময় অবস্থান নেওয়া এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা কঠোরভাবে অনুশীলন করা—এসবই কমরেড মণি সিংহকে পার্টির স্বাভাবিক শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দিয়েছিল। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে সব সময় অনমনীয় থাকলেও তিনি কখনো সংকীর্ণ ছিলেন না।
কমরেড মণি সিংহের কমিউনিস্ট আদর্শবোধই তাঁকে একজন বিশুদ্ধ, অনুপম, অনুকরণীয় দেশপ্রেমিকের পরিচয় এনে দিয়েছে। সততা, ত্যাগ, আদর্শনিষ্ঠা, কঠোর শৃঙ্খলাবোধ, বিপ্লবী আত্মসচেতনা, অধ্যবসায়, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ, দায়িত্ববোধ, দেশমাতৃকার স্বার্থে আত্মস্বার্থ বিসর্জন দেওয়া, জনসেবা-দেশসেবাকে একটি সাধনা হিসেবে গ্রহণ করা, চিন্তা ও কাজে মানবমুক্তির ও দেশপ্রেমের অধ্যয়ন করা, নিত্যদিনের ছোট-বড় সব কাজে বিপ্লবী জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর নিরন্তর প্রয়াস—কমরেড মণি সিংহের মধ্যে এসব গুণ ছিল দৃষ্টান্তস্থানীয়। বর্তমানে যখন অপরাজনীতি, ব্যবসায়িক রাজনীতি, সুবিধাবাদ ও আত্মস্বার্থের রাজনীতি সবকিছুকে গ্রাস করে চলেছে, তখন ‘রাজনীতি বাঁচাও’ জাতির সামনে আজ এক অগ্রগণ্য কর্তব্য। অপরাজনীতিকে পরাজিত করে রাজনীতিকে বাঁচানোর সংগ্রামে মণি সিংহ জাতির সামনে এক অজেয় শক্তিমান প্রতীক হয়ে আছেন। নীতি, আদর্শ, ত্যাগ, দেশপ্রেম, প্রগতির রাজনীতির পুনরুজ্জীবনের পথ দেখাচ্ছেন চিরঞ্জীব কমরেড মণি সিংহ।
কমরেড মণি সিংহ, তোমাকে সালাম!
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
[email protected]