প্রত্যেক পুরুষই পারে কিছু করতে

>আবুল মাল আবদুল মুহিত, ফজলে হাসান আবেদ, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, তপন চৌধুরী, সালমান এফ রহমান, সাবের হোসেন চৌধুরী, আনিসুল হক, মো. সিদ্দিকুর রহমান, জুহান ফ্রিসেল, রবার্ট ডি ওয়াটকিনস্
.
.

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছি। আমাদের পর্যালোচনা থেকে আমরা বিশ্বাস করি, লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে সমাজকে সঙ্গে নিয়ে সরকার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও এ উদ্যোগ সুস্পষ্ট।
আইন ও বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণে সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সংগঠনের প্রয়াস কৌশলগতভাবে উপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস এ বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে এবং আমাদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়। এসব ক্ষেত্রের উন্নতি নিয়ে কথা বলার জন্য আন্তর্জাতিক নারী দিবস একটি সুবর্ণ সুযোগ।
কর্মক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় হিসেবে এই লেখকদের একটি বিশেষ সুযোগ আছে বাইরের অনেককে অনুপ্রাণিত করার। তা সে আন্তর্জাতিক কূটনীতি হোক, জাতীয় অঙ্গীকার হোক, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বা জনমত হোক, আমরা কেবল নিজেদের জীবনই শুধু নয়, বরং আরও অনেকের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রতিশ্রুতি জানাচ্ছি যে আমরা এসব অনুপ্রেরণার মাধ্যমে পরিবর্তন আনবই।
পুরুষ নিজেদের না বদলালে নারীর অবস্থার পরিবর্তন আসবে না। পুরুষদের দৈনন্দিন কর্ম দ্বারাও লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করা যায়। প্রতিটি পুরুষ পারে তার নিকটবর্তী নারীদের অবস্থার পরিবর্তন আনতে। প্রতিদিনই আমরা আমাদের স্ত্রী, কন্যা, বোন, মা, নারী সহকর্মী, ছাত্রী, বাসে বা বাজারে দেখা নারীদের সঙ্গে সংস্পর্শে এসে লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্কগুলো বদলে দিই।
আজ আমরা যাঁরা এই লেখাটিতে স্বাক্ষর করছি, তাঁরা বাংলাদেশের প্রতিটি পুরুষের প্রতি অনুরোধ রাখব, এই ১০টি কাজকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নিতে।
১. সবকিছুর সূচনা হয় পরিবার থেকেই। আমরা আমাদের সন্তানদের যেভাবে গড়ে তুলি, তা সারা জীবন রয়ে যায়। আমরা চাই আমাদের ছেলেসন্তানেরা যেন বড় হয়ে নারীর সম্মান করতে জানে। তারা যেন কখনোই নারীর প্রতি সহিংস আচরণ না করে এবং তারা যেন তাদের বোন ও নারী সহপাঠীদের প্রতি একই রকম আচরণ করে।
২. আমাদের পরিবারে আমরা মেয়ে ও ছেলেদের সমান সুযোগ ও দায়িত্ব দেব। মেয়েসন্তান যেন ছেলের মতো একই মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। আমি আমার মেয়ের মতামত ও অভিজ্ঞতার মূল্য দেব এবং আমার ছেলের মতো একইভাবে তার চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার চেষ্টা করব।
৩. পরিবার ছাড়াও বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার পেছনে স্কুলের একটি বিশাল ভূমিকা আছে। আমি চাই যেন আমার বাচ্চার স্কুলটি আমার মতোই ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ না করে। প্রয়োজনবোধে আমরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও অন্য শিক্ষকদের বলতে পারি যাতে মেয়েদের ছেলেদের মতোই মত প্রকাশের, শিক্ষার ও খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া হয়।
৪. স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই পরিবারের আয়ের ওপর সমান অধিকার আছে। স্বামী ও স্ত্রী দুজনে কেবল সিদ্ধান্ত নয়, বরং দায়িত্বও ভাগ করে নেন। আমার স্ত্রী যদি বাড়ির বাইরে কাজ করতে যান, আমি তাঁকে পুরো সহযোগিতা করব এবং বাচ্চারা বড় হয়ে উঠলে তাঁকে কাজে ফিরে যেতেও সাহায্য করব। নারীর কর্মসংস্থান শুধু আয় বাড়ায় না বরং তাঁদের আস্থা ও ক্ষমতায়নও বাড়ায়।
৫. আমরা আমাদের স্ত্রীদের পুরো পরিবারের দেখভালের পূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখি। অর্থনীতি ও আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত একসঙ্গে তৈরি করি। সংসার চালানো ও সন্তানদের বড় করা দুজনেরই দায়িত্ব। পরিবার ও বাড়ির জন্য সব ভালো কাজের মূল্য নারী ও পুরুষ দুজনেরই দেওয়া উচিত।
৬. আমি আমার ছেলেকে কখনোই ১৮ বছরের নিচের কোনো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব না। আমার মেয়েকেও আমি ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেব না। আমি তাকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সে যত দূর চায়, তত দূর পড়াশোনা করতে সহায়তা করব। আমি আমার পরিবার ও পরিচিতদের মধ্যে কোনো বাল্যবিবাহের খবর পেলে অবশ্যই তা রোধে সরব হব।
৭. আমি কখনোই নারীর ওপর শারীরিক বা যৌন নির্যাতন করব না। আমি কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই শারীরিক মর্যাদা ও সহিংসতামুক্ত জীবনযাপনে নারীর অধিকারের প্রতি সম্মান করব। শারীরিক নির্যাতন আমি রুখে দাঁড়াব।
৮. আমার কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য, হয়রানি ও যেকোনো খারাপ কথার প্রতি খেয়াল করব। এ রকম কোনো কিছু আমার নজরে এলে আমি আমার ব্যবস্থাপককে বিষয়টি জানাব। একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে আমি চেষ্টা করব পুরুষ ও নারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন ও সম্মানসূচক একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে। আমি আরও দেখব যাতে একই কাজের জন্য পুরুষ ও নারীর বেতন যেন একই হয়।
৯. প্রকাশ্য সামাজিক পরিবেশ যেন হয় নারীবান্ধব। আমি যদি বাসে বা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা দেখি, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কথা বলব। নারী ও পুরুষকে একসঙ্গে রেস্তোরাঁ, বাজার বা চায়ের দোকানে দেখা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়।
১০. এই দেশে উত্তরাধিকারসূত্রে নারী ও পুরুষ সমানভাবে সম্পত্তি পায় না। আমি ব্যবস্থা নেব যাতে আমার ছেলেমেয়ে আমার সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকারী হয়।
বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গণ-আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করেই দেশটির জন্ম হয়েছে। যদি কোনো দেশ বৈষম্যমূলক সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চার বিরুদ্ধে লড়তে পারে, তাহলে বাংলাদেশও তা পারবে। আমাদের কবি ও নানা ক্ষেত্রের নায়কেরা স্বাপ্নিক ছিলেন এবং তাঁরা গতানুগতিক ধারাকে ভেঙেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতায় বলা হয়েছে:
‘সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
আবুল মাল আবদুল মুহিত: অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার। স্যার ফজলে হাসান আবেদ: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন, ব্র্যাক। ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তপন চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। সালমান এফ রহমান: ভাইস চেয়ারম্যান, বেক্সিমকো গ্রুপ। সাবের হোসেন চৌধুরী: সাংসদ ও প্রেসিডেন্ট, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন। আনিসুল হক: মেয়র, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। মো. সিদ্দিকুর রহমান: সভাপতি বিজিএমইএ। জুহান ফ্রিসেল: বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। রবার্ট ডি ওয়াটকিনস: বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি।

আরও পড়ুন: