টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নারী-পুরুষ ৫০: ৫০

.
.

দেড় শ বছরেরও বেশি আগের ইতিহাসকেন্দ্রিক একটি দিবসকে বছরান্তে বিশেষভাবে পালন করার উদ্দেশ্য হতে পারে সেই ঘটনা-সম্পৃক্ত অর্জনকে উদ্যাপন করা অথবা ঘাটতি পূরণের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা। ১৮৫৭ সালে আমেরিকার নারী শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণ করে ১৯১০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হয়ে আসছিল। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এখন এই দিবসটিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের একটি তাৎপর্যপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমতা ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ বাস্তবায়নে সরকার ও নাগরিক সমাজের দায়বদ্ধতা পুনর্ব্যক্ত করার অবকাশ সৃষ্টি করে ৮ মার্চ।
বিগত বছরে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর ক্ষমতায়ন-মানবতার উন্নয়ন’। সেই ধারাবাহিকতায় এবং ২০১৫-পরবর্তী বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসজিডি) বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০: স্টেপ ইট আপ ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি’। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) সমাপ্তির পর ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত একটি টেকসই বৈশ্বিক রূপান্তরের উদ্দেশ্যে ১৭টি লক্ষ্য চিহ্নিত করে এসডিজি গৃহীত হয়। এসডিজির ৫ নম্বর লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ‘নারী ও কন্যাশিশুর সমতা অর্জন ও নারীর ক্ষমতায়ন’।
এমডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। স্বাধীনতার চার দশকে অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন একটি বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রণীত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী (২০১৫), নারী-পুরুষবৈষম্য বা জেন্ডার গ্যাপ হ্রাসে বাংলাদেশ ৭৫তম স্থান থেকে ৬৮তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক রূপান্তরে নারীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিশেষ করে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উজ্জ্বলতম উদাহরণ (বিশ্বব্যাংক) হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে নারীর বিশিষ্ট অবদানের ফলে। উল্লেখ্য, নারীশিক্ষার প্রসার, পারিবারিক স্যানিটেশন স্বাস্থ্যসম্মত করা, নারীর প্রজনন হার ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস, উদরাময় নির্মূল ও পুরুষের তুলনায় নারীর গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ইত্যাদিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন নারীরাই, যা পরোক্ষভাবে কর্মক্ষম জনশক্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশের নারী আজও পরিবার ও সমাজের প্রতি স্তরে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এমনকি আমাদের সংবিধানে ‘সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার’ এবং ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার অঙ্গীকার বিবৃত হলেও ব্যক্তিস্বাধীনতা, নিরাপত্তা, নাগরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রেও নারীর মানবাধিকারের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটছে না। তাই এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের পরিপূর্ণ সমতা অর্জন অর্থাৎ ৫০: ৫০ লিঙ্গসমতা অর্জন করতে হলে আমাদের সরকার, রাষ্ট্র, শ্রেণিনির্বিশেষে সব নাগরিকের দায়বদ্ধ করণীয় হিসেবে নিম্নলিখিত ইস্যুসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন: বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন-বিষয়ক প্রায় ১৫টি আইন ও যৌন হয়রানি নিরোধক নীতিমালা এবং এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও এনজিও উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সূত্রমতে নারী ও শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বছর দেড় মাসের মধ্যে ৩৭টি শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে (প্রথম আলো)। বিবিএস জরিপ (২০১২) অনুযায়ী, ৭৬ শতাংশ নারী তাঁদের স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন। প্রতি ১২ মিনিটে একজন নারী যৌতুকের দাবিতে নির্যাতিত এবং প্রতি ২১ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন (এশিয়ান এজ)। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশের অগ্রগতিতে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান করতে হবে, পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক করতে হবে এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের সোচ্চার হতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনে সরকারের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, তার অঙ্গীকারস্বরূপ সিডও সনদের ধারা ২ ও ১৬ (চ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে সনদকে কার্যকর করতে হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদান দৃশ্যমানকরণ: সার্বিক মূল্যায়নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নারীর বিরাট অবদান রয়েছে। চরম দারিদ্র্য হ্রাস ও ক্ষুধা নির্মূলের একটি মূল কারণ উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন, যা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে কৃষি খাতে ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী নিয়োজিত, যার বিরাট অংশ মজুরিবিহীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। রপ্তানি খাতের সিংহভাগ রেমিট্যান্স আসছে নারী শ্রমিকের মাধ্যমে। কিন্তু এই অবদানের অধিকাংশ জাতীয় জিডিপিতে প্রতিফলিত হচ্ছে না। ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ৯১ লাখ নারী গৃহস্থালির কর্মে নিয়োজিত। অ্যাকশনএইড ও ব্র্যাকের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, নারীর জীবনের প্রায় ১২ বছর কেটে যায় রান্না করে (প্রথম আলো)। কিন্তু নারীর এই নিরন্তর অবদান প্রায়ই রয়ে যায় মূলধারার অগোচরে। গণমাধ্যমে জেন্ডারবৈষম্য নিয়ে প্রতিবেদন অনুযায়ী (২০১৫) নারী গুরুত্ব পায় মাত্র ১০ শতাংশ সংবাদে। আমাদের গণমাধ্যমকে আরও নারীবান্ধব হতে হবে এবং সব পরিসংখ্যানে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান এবং প্রচারমুখর করতে হবে।
ভূমিজ ও আর্থিক সম্পদে নারীর অভিগম্যতা সৃষ্টি: নারী-পুরুষ সমতার একটি প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সম্পদ সৃষ্টি ও ভোগে সমান অধিকার এবং নিজের শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য মজুরি অর্জন করতে পারা। কিন্তু আমাদের বিদ্যমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ও আইনি কাঠামো বৈষম্যমূলক হওয়ায় সম্পদ সৃষ্টি ও ভোগে নারীর প্রবেশগম্যতা সীমিত। উপরন্তু বাল্যবিবাহের কারণে পারিবারিক উৎস থেকে সম্পদ প্রাপ্তিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী বঞ্চিত হয়। সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে শ্রেণিবৈষম্যের সঙ্গে লিঙ্গবৈষম্য যোগে নারী তুলনামূলকভাবে অধিক দারিদ্র্য ও ক্ষমতাহীনতার শিকার। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ নারী ভূমিজ ও আর্থিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিধারায় সম্পদ কেন্দ্রীকরণের প্রবণতার কারণে নারী-পুরুষ সমতা অর্জন ও নারীর ক্ষমতায়ন আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, যদি আশু পদক্ষেপ গৃহীত না হয়।
আন্তর্জাতিক এনজিও অক্সফামের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সম্পদ থাকবে ১ শতাংশ ধনীর কুক্ষিগত, যা শুধু বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিপৎসংকেত নয়, আমাদের মতো উঠতি অর্থনীতির জন্য ডেকে আনতে পারে এক ভয়াবহ পরিণাম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধাভোগী হবে মুষ্টিমেয় জনগণ এবং কেন্দ্রীভূত সম্পদ আরও প্রখর শ্রেণি ও লিঙ্গবৈষম্য সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশে এ বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পূর্বঘোষিত আয়ের তুলনায় বেশি হয়েছে (৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ) এবং মাথাপিছু গড় আয়ও প্রত্যাশিত আয়ের তুলনায় বেড়ে ১ হাজার ৩১৬ ডলার হয়েছে (অর্থমন্ত্রী)। কিন্তু এই উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন সত্ত্বেও বিগত পাঁচ বছরে আমাদের আয়বৈষম্য কমেনি (মইনুল ইসলাম, প্রথম আলো)। যেকোনো সমাজে প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য যদি বর্ধিত সম্পদে প্রবেশগম্যতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন তুলনামূলকভাবে আরও সংকুচিত হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিগত চার দশকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগিয়ে নিতে আমাদের নারীর অবদান অনস্বীকার্য হলেও আজও পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারী ‘মানুষ’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। এ সমস্যার মূল কারণ, আমাদের উন্নয়ন দর্শন ও অগ্রাধিকার নির্ণয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন কখনো ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।
এ বছরের ৮ মার্চের প্রতিপাদ্য তাই বিশ্বকে প্রত্যয় ঘোষণার আহ্বান জানায় যে জেন্ডার সংবেদনশীলতার জন্য অপেক্ষা করার আর সময় নেই। আমাদের উন্নয়ন এজেন্ডায় কৌশলগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক—প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ৫০: ৫০ সম-অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এসডিজি তথা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার আর কোনো বিকল্প নেই।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।

আরও পড়ুন: