গণতন্ত্রে জোর জবরদস্তি ও পাকে পড়া গণমাধ্যম

বন্ধ হয়ে যাওয়া নিউজ পোর্টাল মালয়েশিয়ান ইনসাইডারের ওয়েব পেইজে গেলে যা দেখা যাবে
বন্ধ হয়ে যাওয়া নিউজ পোর্টাল মালয়েশিয়ান ইনসাইডারের ওয়েব পেইজে গেলে যা দেখা যাবে

এই নিউজ পোর্টালটির প্রতি সরকার কেন এতটা খেপেছে, তা বোঝার জন্য কিছু তথ্য জানা দরকার। মালয়েশিয়ান ইনসাইডার দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার জমা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। বন্ধ ঘোষণার পর গত মঙ্গলবার মালয়েশিয়ান ইনসাইডারের ওয়েব পেজে গিয়ে দেখা গেল এর কর্মীদের সাদা-কালো একটি ছবি। তাঁদের কেউ কেউ ভি চিহ্ন তুলে ধরেছেন। ওপরে ইংরেজিতে লেখা আছে, Thank you Malaysia। আর নিচে লেখা, From all of us at The Malaysian Insider। কর্মীদের সবাই হাসিমুখেই ছবিটি তুলেছেন। কিন্তু বড়ই মন খারাপ করা এক ছবি! মনে পড়ে গেল ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট বিএনপি সরকার কীভাবে হামলে পড়ে, কী আক্রোশে একুশে টিভির সম্প্রচার বন্ধ করেছিল! আমাদের যেসব বন্ধু তখন সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, তাঁদের তখনকার সেই ক্ষোভ, কষ্ট আর হাহাকারের কথা পরিষ্কার মনে করতে পারি।

মালয়েশিয়ান ইনসাইডারের সম্পাদক জাহাবার সাদিক পোর্টালটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গার্ডিয়ান পত্রিকায় (১৬ মার্চ ২০১৬) একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘১৫ মার্চ ২০১৬ থেকে নিউজ পোর্টালটি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে আমিসহ ৫৯ জন কর্মী চাকরি হারিয়েছি। আর মালয়েশিয়া হারিয়েছে স্বাধীন খবর পাওয়ার আরও একটি উৎস।’ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ব্যক্তিগত হিসাবের অর্থের উৎস নিয়ে প্রতিবেদন করার পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর নিউজ পোর্টালটি ব্লক করে দেওয়া হয়। সরকার এই প্রতিবেদনের সমালোচনা করেছে, কিন্তু এই অর্থের সূত্রের বিষয়টি কখনো পরিষ্কার করেনি। নিউজ পোর্টালটি কেন ব্লক করা হয়েছে, সে ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। শুধু একজন মন্ত্রী বলেছেন, নিউজ পোর্টালটি ‘জনগণকে বিভ্রান্ত করছে’। ইন্টারনেট তদারকি সংস্থা এমসিএমসি এ বছর এ পর্যন্ত ৫২টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন মালয়েশিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি স্বাধীন’।

তুরস্কের টুডেজ জামান পত্রিকার সম্পাদক সেভিগি আকারজেসমে একইভাবে তাঁর পত্রিকা সরকার দখল করে নেওয়ার পর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় (৮ মার্চ ২০১৬) একটি লেখা লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘এমনিতেই তুরস্কের অধিকাংশ পত্রিকা ও টেলিভিশনের ওপর দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কার্যত প্রভাব থাকলেও তিনি এটা যথেষ্ট মনে করেননি। ফলে গত শুক্রবার (৪ মার্চ) তিনি স্বৈরাচার শাসকের জোশ নিয়ে আমাদের পত্রিকা টুডেজ জামান ও তার মূল পত্রিকা তুর্কি ভাষায় প্রকাশিত জামান দখল করে নেন।’

আমরা দেখছি, দুনিয়াজুড়ে বর্তমানে গণতন্ত্রের যে দুর্দশা, তার সুযোগ নিচ্ছে কিছু ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার। গণতন্ত্র হয়ে উঠছে জবরদখলের গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে সরকাগুলো। এর চাপটা সেই সব দেশের গণমাধ্যমের ওপর এখন চরমভাবেই পড়তে শুরু করেছে। কর্তৃত্ববাদ স্বাধীন গণমাধ্যম পছন্দ করে না বা একে ভয় পায়। ফলে নানা কায়দায় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার পথই বেছে নেয়। বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে এই ধারার নেতৃত্বে রয়েছে রাশিয়া। বছর দুয়েক আগে ফোর্বস ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন আমেরিকান সাংবাদিক মেলিক কোলন। পুতিনের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ববাদী শাসন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, মুক্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পথ দেখিয়েছেন পুতিন। সাংবাদিক খুন বা জেলে পোরা, মারধর বা হুমকির শিকার হওয়ার মতো ঘটনার সূচনা ঘটায় তাঁর শাসন। এই মডেল এখন শুধু তুরস্কে নয়, পশ্চিমের বাইরে অনেক দেশেই জায়গা করে নিচ্ছে।

মেলিক কোলন লিখেছেন, ‘একসময় আমরা মনে করেছিলাম, স্যাটেলাইট ও টেলিভিশনের প্রসারের কারণে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, চ্যানেলগুলোর ওপর নিজেদের সমর্থকদের মালিকানা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম, ইন্টারনেটের কারণে কর্তৃত্ববাদী শাসন অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এমনকি সামাজিক মাধ্যমও ভুল তথ্যে ভেসে যেতে পারে, যেটা এখন তুরস্কে হচ্ছে। বিদেশি প্রতিনিধি বলে গণতান্ত্রিক এনজিও বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয় রাশিয়ায়, এরপর তা ক্রমেই মিসরসহ আরব বসন্তের বাতাস লাগা অন্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।’

রাশিয়ার গণমাধ্যম কার্যত এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং তা এতটা শক্ত-পোক্ত হয়েছে যে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পুতিনের প্রচারযন্ত্র সোভিয়েত আমলের চেয়েও খারাপ। মেলিক কোলন লিখেছেন, ‘অধিকাংশ টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের ওপর ফেডারেল সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, ফলে পুতিন অভ্যন্তরীণ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন বেশ কার্যকরভাবেই। যেসব প্রকাশনায় সরকারের ভাষ্য চ্যালেঞ্জ করা হয়, তাদের নিয়মিতভাবেই হেনস্তা করা হয় আর শেষমেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুতিনকে নিয়ে যেকোনো নেতিবাচক খবর চাপা দেওয়া হয়।’

তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, নিজের দেশে পত্রিকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বা প্রকাশনা বন্ধ হওয়ার পর দুই সম্পাদক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লেখালেখি করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। তুরস্কের টুডেজ জামান পত্রিকার সম্পাদক তো তাঁর লেখায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও চেয়েছেন। ‘পশ্চিম যদি স্রেফ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যবসা ও আঞ্চলিক চুক্তির স্বার্থে চোখ বুজে থাকে, তাতে ক্ষণিকের প্রয়োজন মিটতে পারে। কিন্তু তারা যদি এরদোয়ানের কর্তৃত্বপরায়ণতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নেয়, তাহলে তারা এক স্থিতিশীল মিত্র হারাবে, যারা কিনা মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে এক বিরল গণতান্ত্রিক দেশ।’

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নিজের দেশে নিয়ন্ত্রণ, হয়রানি বা চাপের শিকার হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই সাহায্য চাওয়ার মধ্য দিয়ে আদৌ কোনো মোক্ষ লাভের সুযোগ আছে কি? এটা এখন মানতেই হবে যে বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে বিভিন্ন দেশে সরকারগুলো যেভাবে কর্তৃত্ববাদী ও নিয়ন্ত্রণমূলক হয়ে উঠছে, তাতে বাইরের কোনো শক্তির চাপ বা হস্তক্ষেপের সুযোগ কমে আসছে। মার্কিন থিংক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের রাবার্ট কেগান প্রতিষ্ঠানটির জার্নালে ‘ইজ ডেমোক্রেসি ইন ডিক্লাইন’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে লিখেছেন, গণতন্ত্রের পক্ষে পশ্চিমাদের একসময় যে অবস্থান ছিল, এখন আর তা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় তারা একসময় যে ভূমিকা পালন করেছিল, সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। পশ্চিম সম্ভবত এখন তার নিজের সমস্যা সামাল দিতেই ব্যস্ত। তাঁর মত হচ্ছে, সে জন্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা জোরদার হয়েছে।

পশ্চিমের সাহায্য-সমর্থন কমে যাওয়ায় যদি দেশে দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে থাকে বা দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্র দুর্দশার মধ্যে পড়ে, তবে বুঝতে হবে, এত দিন যে কায়দায় গণতন্ত্রের পক্ষে পশ্চিম সমর্থন জুগিয়ে গেছে, তা খুব কাজে দেয়নি। বোঝা গেল, বাইরের চাপে, সাহায্যে বা সমর্থনে যে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তা শেষ পর্যন্ত কাজে দেয় না। গণতন্ত্রের নামে দেশে দেশে চেপে বসা কর্তৃত্ববাদী বা জবরদখলের শাসন ঠেকানো, গণতন্ত্রকে জোরদার বা চাপে পড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার পথ তবে কী? মানতে হচ্ছে, সময় যতই লাগুক, গণতন্ত্র ও স্বাধীন গণমাধ্যম নিশ্চিত করার লড়াইটা প্রতিটি দেশের নিজস্ব লড়াই। দেশে দেশে গণতন্ত্রের বর্তমান দশা নিয়ে শঙ্কিত রাজনীতিবিদ ও সিভিল সোসাইটিকে ভরসা রাখতে হবে নিজের দেশের জনগণের ওপর। আর গণমাধ্যমকে ভরসায় নিতে হবে তার পাঠক ও দর্শককে। এটা এক নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন বাস্তবতা। 

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।