অতিদারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রাম

>
বিয়ন লোমবোর্গ
বিয়ন লোমবোর্গ
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ প্রকাশ করা হলো দ্বিতীয়টি।

বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি, সেগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য অবশ্যই সবচেয়ে গুরুতর একটি। এবং এখনো এই ক্ষেত্রে প্রচুর কাজ করার আছে। চরম দারিদ্র্যের হার ২০০০ সালে ৩৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে আজ মাত্র ১৩ শতাংশে আনা সত্ত্বেও ২ কোটি বাংলাদেশি এখনো দরিদ্রতম হিসেবে বিবেচিত পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। প্রতিদিন ৪৩ টাকারও কম পরিমাণ অর্থে জীবন ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন হতে পারে, এবং কারও কারও ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি একধরনের ফাঁদ তৈরি করতে পারে—যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

হতদরিদ্র জনগণ সাধারণত জমির মালিক হয় না এবং তারা কম মজুরির শ্রমজীবী কর্মকাণ্ডের ফাঁদে আটকা পড়ে থাকে। তারা অস্তিত্ব রক্ষার প্রান্তে বসবাস করছে। আর যখন কেউ শুধু তার আজকের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই সংগ্রাম করে যাচ্ছে, আগামীকালের ব্যাপারে চিন্তা করা বা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করার মতো বিলাসিতা তার থাকবে না। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি নিজেদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে যে ২০২০ সাল নাগাদ আরও ৬০ লাখ জনগণকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে আনবে। একইভাবে জাতিসংঘের ২০৩০ সালের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটি, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা হলো চরম দারিদ্র্য সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা। উভয় ক্ষেত্রেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। কীভাবে আমরা সবচেয়ে কার্যকরী উপায়ে চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি?

আমাদের প্রকল্প, ‘বাংলাদেশের অগ্রাধিকারসমূহ’, দেশের জন্য বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনার পরিসর নিয়ে বিশ্লেষণ করে। আমাদের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দুজন, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের মুনশী সুলাইমান এবং রোটারডামের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারজানা মিশা, বাংলাদেশে দারিদ্র্য মোকাবিলা করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপায় বিশ্লেষণ করে দেখেছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেনিয়া ও উগান্ডার মতো দেশগুলোতে নগদ অর্থের হস্তান্তর বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং আমাদের অর্থনীতিবিদেরা এই পদ্ধতিটিই প্রথম বিশ্লেষণ করেছিলেন। এ ধরনের কর্মসূচিতে গ্রাহকদের, সাধারণত যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অর্থ ব্যবহারের বিষয়ে কোনো শর্ত দেওয়া ছাড়াই একটি এককালীন অর্থ হস্তান্তর করা হয়।

কোনো শর্ত ছাড়াই অর্থ প্রদান কেন? দেখা গেছে যে বেশির ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণায় এটিকে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে পাওয়া গেছে, যা এটি এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একটি অন্যতম কারণ। যদিও আমাদের পর্যালোচিত নগদ অর্থ হস্তান্তরের ঘটনাগুলো অনুযায়ী, যেখানে প্রতিটি প্রাপক পরিবারের পেছনে খরচ হয়েছে ১৮ হাজার ৯৬ টাকা, প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে তারা মাত্র ৮০ টাকা সঠিকভাবে খরচ করেছে। এই কৌশলগুলো অন্যান্য কৌশলের তুলনায় কার্যকরী না হওয়ার পেছনে একটি কারণ হলো যে সময়ের সঙ্গে এর প্রভাব কমে যাওয়া, চরম দারিদ্র্যে বাস করা কারও জন্য একটি এককালীন অর্থসাহায্য অল্প সময়ের জন্য সহায়ক হতে পারে, কিন্তু এর প্রভাব ক্ষণস্থায়ী।

দ্বিতীয় কৌশলটি গতানুগতিকভাবে বেশির ভাগ দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলগুলো যা করেছে তাকেই গুরুত্ব দেয়: মানুষকে একটি জীবিকাভিত্তিক ‘উৎসাহ’ প্রদান করা, যাতে তারা নিজেরাই উন্নতি লাভ করতে পারে। ‘জীবিকা কর্মসূচি’ কৃষি–বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও চাষাবাদের উপকরণগুলো, যেমন কৃষককে উন্নত বীজ দিতে পারে। আমাদের গবেষকদের চর্চিত কিছু জীবিকা সম্পৃক্ততা অন্যগুলোর তুলনায় বেশি আশাপ্রদ ছিল এবং এ ধরনের একটি কর্মসূচির জন্য খরচও ছিল সস্তা, প্রতি পরিবারের জন্য ৭ হাজার ৮০০ টাকারও কম। কিন্তু এসব প্রচেষ্টায় একান্তভাবে ব্যয়ের ফলাফল ছিল নিছক একতরফা।

দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার আরেকটি উপায় এবং আমাদের বিশ্লেষিত তিনটি কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল হলো ‘উত্তরণ’। এ পদ্ধতিতে প্রাপককে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সাহায্য করা হয়। উত্তরণ কর্মসূচিতে, অংশগ্রহণকারীরা প্রথমে নগদ বা খাদ্যরূপে একটি ছোট উপহার পায়, যা তাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার চাপ কমায় এবং তাদের সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এরপরে তারা একটি সম্পদ পায়, হয়তোবা একটি গরু বা একটি ছাগল, প্রাথমিক আর্থিক ও কারিগরি শিক্ষাসহ।
এই অংশে প্রায়ই একজন পশুবিশেষজ্ঞ দ্বারা পশুপালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অনেক উত্তরণ কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যসেবার সমর্থন প্রদান করা হয়ে থাকে, যেন অংশগ্রহণকারীরা কোনো জরুরি অবস্থায় সম্পদ বিক্রি করে দিতে বাধ্য না হয়। অবশেষে অংশগ্রহণকারীরা সামাজিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস লাভ করে—যেটি দারিদ্র্য বিমোচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়।

অর্থ, সম্পদ এবং আর্থিক ও সামাজিক সমর্থন আকারে এই সহযোগিতা অংশগ্রহণকারীদের একটি প্রদত্ত সময়সীমায় চরম দরিদ্র অবস্থা ‘উত্তরণ’-এর মাধ্যমে বের হয়ে আসার পথ দেখায়। আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এ ধরনের একটি প্রোগ্রামের খরচ তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, প্রতি পরিবারের জন্য আনুমানিক ২৩ হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু এর সুবিধাগুলো উল্লেখযোগ্যও হবে। উত্তরণ কর্মসূচি প্রাপকদের আয় অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি করবে এবং এটা বলা যায় যে পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে কিছুটা কমই চিন্তা করা হয়েছে, কারণ এই গবেষণা শুধু আয়ের উন্নতি দেখিয়েছে কিন্তু পরিবারের শিশুদের পুষ্টি–সম্পর্কিত উন্নয়ন দেখায়নি।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশে উত্তরণ কর্মসূচিতে প্রতি এক টাকা ব্যয় করে দুই টাকার সমান সামাজিক কল্যাণ করা যেতে পারে, অংশগ্রহণকারীদের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের ব্যবস্থা এবং অবশেষে চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধ্যমে। বেশির ভাগ উন্নতি, সুবিধাভোগীদের জীবিকা ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং সাধারণ দিনমজুর অবস্থা থেকে উন্নতি লাভ করে স্বকর্মসংস্থানের কারণে হয়। এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে ইতিবাচক উত্তরণ কর্মসূচির প্রভাব কর্মসূচি সমাপ্তির পরও দীর্ঘস্থায়ী হয় বছরের পর বছর; যার অর্থ হলো অংশগ্রহণকারীদের নিজেদের দীর্ঘ সময়ের জন্য দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার সম্ভাবনা আছে।

চরম দরিদ্রদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে এটি একটি বেশ মর্যাদাপূর্ণ সুফল। আমাদের বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশে জীবিকা এবং নগদ অর্থ হস্তান্তর কর্মসূচির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের ওপর আরও গবেষণা করা উচিত। কিন্তু আমাদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই তিনটি কৌশলের মধ্যে ‘উত্তরণ’-ই সবচেয়ে বেশি আশাপ্রদ বলে মনে হয়।

পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে আমরা বিদেশি ও জাতীয় উন্নয়ন অর্থ দিয়ে আর কী কী করতে পারি, সে বিষয়ে ‘বাংলাদেশের অগ্রাধিকার’ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করব। এই দারিদ্র্য নীতিগুলো হলো দেশ মনোনিবেশ করতে পারে এমন ৭৮টি পদ্ধতির মধ্যে মাত্র তিনটি। আপনার কী মনে হয়? এগুলো কি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগগুলোর মধ্যে কয়েকটি? <https://copenhagen. fbapp. io/povertybangla>-এ আপনার বক্তব্য শোনা যাক। বাংলাদেশ কোন ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।

ড. বিয়ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।