আসুন, আমরা জান্নাতের মতো হই

খাতুনে জান্নাত
খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত রাজধানীর মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ১৩ বছর বয়সী এই মেয়েটি নিজের উদ্যোগে একটি কাজ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। স্কুল প্রাঙ্গণ কিংবা রাস্তার আনাচকানাচে পড়ে থাকা চিপসের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট, কাগজ ইত্যাদি তুলে সে আশপাশে থাকা ডাস্টবিনে ফেলছে। অনেক সময় রাস্তার ময়লা ব্যাগে ভরে ফেলছে নিজের বাড়ির ডাস্টবিনে। নিজের স্কুল থেকে প্রথমে একা একা কাজটি শুরু করেছিল জান্নাত। পরে কয়েকজন বন্ধু তার সঙ্গে যোগ দেয়। কিন্তু তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে অন্য বন্ধুরা। কিন্তু তাতে দমে যায় না জান্নাতরা। বরং মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটুকু করে যাচ্ছে তারা।
চলতি মাসের ‘কিশোর আলো’ ম্যাগাজিনে জান্নাতের এই শুভ উদ্যোগের খবরটি ছাপা হয়। কিশোর আলোর পক্ষ থেকে জান্নাতের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন সে এমন একটি উদ্যোগ নিল। জান্নাতের উত্তর ছিল, সবাই শুধু বাংলাদেশকে নোংরা বলে। বলে, এই দেশের কিচ্ছু হবে না! দেশটা গোল্লায় যাচ্ছে, ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। কিন্তু কেউ উদ্যোগ নিয়ে পরিষ্কার করে না।
অবাক হয়ে দেখি জান্নাতের কাণ্ড। ভাবি, সত্যিই তো কেউ তো আজ পর্যন্ত তার মতো করে ভাবেনি। এমনকি এই ঢাকা নগরের পরিষ্কারের দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই সিটি করপোরেশন কি কখনো জান্নাতের মতো ভেবেছে? সিটি করপোরেশনের হর্তাকর্তাদের চোখে কি পড়ে এই মহানগরের রাস্তা ও ফুটপাতে পড়ে থাকা ময়লা–আবর্জনাগুলো! নিশ্চয়ই পড়ে। কিন্তু তাঁদের কি কখনো মনে হয়, নগরটিকে ঝকঝকে তকতকে করে তুলি? এ কাজ তো তাঁদেরই করার কথা। তবু তাঁরা একটুও লজ্জিত হন না। একটুও অনুশোচনা জাগে না তাঁদের মনে। জাগলে নিশ্চয়ই এভাবে ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় পড়ে থাকত না।
ঢাকা শহর যে এখন অপরিচ্ছন্ন নগরে পরিণত হয়েছে, তা যাঁরা এখানে থাকেন তাঁদের নিশ্চয়ই নতুন করে বলার দরকার নেই। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা। যেন ময়লা ফেলার আলাদা কোনো স্থান নেই। পুরো নগরই ময়লার ভাগাড়। গৃহস্থালির ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে এনে রাখা হচ্ছে নগরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের গেটের পাশে কিংবা প্রধান সড়কের ওপর রাখা সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী ডাস্টবিনে। এখানে ফেলা ময়লার বেশির ভাগই পড়ে ডাস্টবিনের বাইরে। এসব ময়লা আবার যানবাহনের চাকার সঙ্গে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য স্থানে। ফলে নোংরা শহর আরও নোংরা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতিদিন ঢাকা শহরের বাসাবাড়ি থেকে প্রায় সাত হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। যার প্রায় ৫০ শতাংশ সরকারিভাবে অপসারণ করা হলেও বাকি অংশ থেকে যায় নগরের অলিতে-গলিতে, পথে-ঘাটে। এসব ময়লা-আবর্জনার মধ্যে আবার ২০০ টন বর্জ্য থাকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের। এসব বর্জ্যের প্রায় ২০ শতাংশই প্রাণঘাতী জীবাণু বহন করে থাকে। তাই এগুলো খুবই বিপজ্জনক। ফলে জনস্বাস্থ্য পড়ছে মারাত্মক হুমকির মুখে।
ময়লা অপসারণ, রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, ড্রেন পরিষ্কার করা ইত্যাদি কাজ পরিচালনা করা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অন্যতম প্রধান কাজ। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি ঠিকভাবে হচ্ছে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ অজুহাত হিসেবে খাড়া করছে জনবলসংকট ও আন্তবিভাগ সমন্বয়হীনতাকে। হয়তো তারা ঠিকই বলছে। তবে অপরিচ্ছন্নতার জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অবহেলাও অনেকাংশে দায়ী। একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও এঁদের বেশির ভাগ কর্মীই তিন-চার ঘণ্টার বেশি কাজ করেন না বলে অভিযোগ আছে। নিজের চোখে দেখেছি, অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেন ঠিকই, কিন্তু ঠিকভাবে ঝাড়ু দেন না। রাস্তার এক পাশ দেন তো আরেক পাশ দেন না। ময়লা নিয়ে জমা করেন গলির মাথায়। সেই ময়লা আবার সারা দিনে চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।
গত বছর ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের জন্য দুজন নতুন সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নগরবাসীর মনে আশা জেগেছিল, এবার হয়তো ঢাকা মহানগরের পরিবর্তন হবে। কিছু উদ্যোগ শুরু হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা এর ফলটি দেখতে চাই। তবে একটি অপরিচ্ছন্ন নগরের দায় শুধু সিটি করপোরেশনের ওপর চাপিয়ে বসে থাকলেই হবে না। নগরবাসীরও দায়িত্ব আছে এ নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখার। এ নগরে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা বাড়ির আবর্জনা নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলার কষ্টটুকু করেন না। রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি রাস্তা বা গলির মাথায় ময়লা ফেলেন বা প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে ফেলেন। তাঁদের মনোভাব এমন, অন্যের বাড়ির সামনে ময়লা থাকে থাকুক, আমার বাড়ির সামনেটা তো পরিষ্কার।
গত কয়েক বছরে নগরের অনেক এলাকায় গড়ে উঠেছে কল্যাণ পরিষদ। এসব পরিষদ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এলাকার প্রতিটি বাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার ব্যবস্থা করে। এর বিনিময়ে প্রতি বাড়ি থেকে আদায় করা হয় কোথাও ৫০, কোথাও বা ১০০ টাকা। অনেকেই আছেন যাঁরা এই ১০০ টাকাও খরচ করতে চান না। তাঁদের উদ্দেশে বলছি, একটু খরচ করুন। একটু সচেতন হোন। আপনার একটুখানি সচেতনতা এই নগরকে করতে পারে ময়লা ও আবর্জনামুক্ত। এই নগর তো আমাদেরই। জান্নাত যদি পারে তবে আমরা কেন পারব না। জান্নাতের মতো আন্তরিকতা কেন আমাদের নেই। আসুন, আমরা সবাই জান্নাতের মতো হই।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।