কিউবায় যুক্তরাষ্ট্র: কে কাকে বদলাবে?

হাভানায় ঐতিহাসিক সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা ও রাউল কাস্ত্রো
হাভানায় ঐতিহাসিক সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা ও রাউল কাস্ত্রো

কিউবাকে পুরো অধস্তন একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পুরোনো। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে দক্ষিণ আমেরিকাই ছিল তার আগ্রাসনের লক্ষ্য। ১৮৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের ভাষ্য বলতে গিয়ে সে সময়কার প্রভাবশালী একটি পত্রিকা দ্য ম্যানুফ্যাকচারার লিখেছিল: ‘কিউবাকে নিয়ে আমরা কী করব? জাতিগতভাবেই এরা খুব দুর্বল, অসুস্থ। এরা সব অলস, নৈতিকতার কোনো ঠিক নেই। একটা আধুনিক দেশে থাকার মতো কোনো যোগ্যতা এদের নেই। প্রাকৃতিকভাবেই এরা অক্ষম।’ এর কিছুদিন পরই হোসে মার্তি স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করেন, যার শেষ হয় ১৯৫৯ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। কিউবার জনগণই উচিত জবাব দিয়েছেন।

১৮৯৮ সালে, যে বছর হোসে মার্তি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতে নিহত হলেন, সেই বছর যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধমন্ত্রী কিউবা ও পুয়ের্তো রিকো কীভাবে দখল করতে হবে, তা সেনাবাহিনীর প্রধানকে জানাচ্ছেন এই ভাষায়: ‘পুয়ের্তো রিকো থেকে কিউবা আকারেও বড়, লোকসংখ্যাও বেশি। এখানে শ্বেতাঙ্গ আছে, কৃষ্ণাঙ্গ আছে, আদিবাসী আছে, আর আছে মিশ্র জনগোষ্ঠী। এটা স্পষ্ট যে আমাদের ফেডারেশনে এখনই এই অবস্থায় এর অন্তর্ভুক্তি হবে পাগলামি। তার আগে এটাকে পরিষ্কার করতে হবে। এর জন্য যদি আদিম পথ নিতে হয়, তা-ও ভালো। আমাদের কামানের সীমার মধ্যে যা পড়বে, সেসব ধ্বংস করতে হবে। আমাদের অবরোধও জোরদার করতে হবে, যাতে ক্ষুধা আর তার চিরদিনের সাথি প্লে­গ বেসামরিক জনসংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং সেনাবাহিনীকে কাবু করে ফেলে।’

হিটলারের বয়স তখন নয় বছর। কিন্তু সেই বর্ণবাদী আর ফ্যাসিস্ট কণ্ঠ আমরা তখনই পেয়েছি ‘গণতান্ত্রিক’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

১৯৫৯ সালে বাতিস্তা বাহিনীর শেষ চেষ্টা ব্যর্থ করে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা কিউবার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে অন্তর্ঘাত, সরাসরি হামলা, গুন্ডাবাহিনী গঠন ও চক্রান্ত। ১৯৬০ সালের ৪ মার্চ হাভানা বন্দরে একটি ফরাসি জাহাজ উড়িয়ে দিয়ে এর আনুষ্ঠানিক শুরু। এতে নিহত হয় ৮১ জন মানুষ। কিউবার বিপ্লবের স্লোগান ওঠে ‘বিপ্লব অথবা মৃত্যু’। ১৯৬০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মার্কিন আইজেনহাওয়ার কিউবান প্রতিবিপ্লবীদের দিয়ে কিউবা আক্রমণের জন্য সিআইএকে নির্দেশ দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকার কারণেই কিউবা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুত গড়ে উঠেছিল। ১৯৬০ সালের ৮ মে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিউবা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তেল কিনে তা শোধনের জন্য তখন পর্যন্ত কার্যরত টেক্সাকো, এসো ও শেলের রিফাইনারিতে দিলে তারা সোভিয়েত তেল শোধন করতে অস্বীকার করে। কিউবা এরপর সব শোধনাগার জাতীয়করণ করে। জুনের ২৯ থেকে ১ জুলাইয়ের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। এরপরই ৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে চিনি কেনা বন্ধ ঘোষণা করে। ৯ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার চিনি কেনার ঘোষণা দেয়। ৬ আগস্ট কিউবা মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে সব বৃহৎ মার্কিন ব্যবসা জাতীয়করণ করে। এর দুই মাসের মাথায় দেশি-বিদেশি ৩৮২টি বৃহৎ ব্যাংক জাতীয়করণ করা হয়।

প্রেসিডেন্ট কেনেডির সময়ে ১৯৬১ সালের এপ্রিলে শুরু হয় সিআইএ  ও কিউবান প্রতিবিপ্লবীদের সরাসরি যৌথ হামলা। এই প্রজেক্টে যেসব সিআইএ এজেন্ট ও কিউবান সন্ত্রাসীরা অংশগ্রহণ করেছিল, তারা বিভিন্ন সময়ে তাদের ব্যর্থতার বিষয়ে সাক্ষাৎকারও দিয়েছে। ১৯৬১ সালের ১৫ এপ্রিল কিউবার দুই মাথায়—সান্তিয়াগো ও হাভানায়—বোমা হামলা হয়। ১৭ তারিখ সিআইএর প্রশিক্ষণে পুষ্ট প্রায় ১ হাজার ৫০০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী বে অব পিগসে হামলা করে। লক্ষ্য ছিল একটি অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়ে তারা অস্থায়ী সরকার গঠন করে যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাবে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের পরাজিত করে কিউবার বিপ্লবী মিলিশিয়া। চে গুয়েভারাও এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বস্তুত, ১৯৬১ সাল থেকে আরোপিত মার্কিন অবরোধের উদ্দেশ্যই ছিল কিউবাকে বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে পিষে মেরে ফেলা। এমন পরিণতি নিয়ে আসা, যাতে আর কখনো ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে, যাতে কেউ বিপ্লবের স্বপ্ন না দেখে। পারেনি যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা তার স্বপ্ন ও শক্তি দিয়ে পুরো লাতিন আমেরিকাকে উদ্দীপ্ত করেছে।

কিউবার মুক্তিসংগ্রামের প্রতীক হোসে মার্তির নাম ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র আর তার মাফিয়া দল কিউবান বিপ্লববিরোধী রেডিও প্রচার শুরু করেছে ১৯৬১ থেকেই। পরে টিভি স্টেশনও খুলেছে। এগুলোর নাম দিয়েছে রেডিও মার্তি, টিভি মার্তি। ২০টিরও বেশি রেডিও-টিভির মাধ্যমে এত বছর ধরে অব্যাহতভাবে বিপ্লববিরোধী, ফিদেলবিরোধী ও ভোগবাদ সম্প্রসারণের পক্ষে প্রচার চলছে। অন্যদিকে কিউবার সব রকম প্রকাশনা, অডিও-ভিডিও, এমনকি ভোগ্যপণ্য সবকিছুই যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ।

২০০৪ সালে বুশ প্রশাসন কিউবায় সন্ত্রাস পরিচালনা, প্রয়োজনে সামরিক আগ্রাসন ও ক্ষমতা দখলের কাজ গোছানোর জন্য ‘কমিশন ফর অ্যাসিস্ট্যান্স টু আ ফ্রি কিউবা’ নামে নতুন কমিশন করেছে। এর অংশ হিসেবে ২০০৫ সালের জুলাই মাসে কিউবা দখলের জন্য একজন ট্রানজিশন কো-অর্ডিনেটরও নিয়োগ করা হয়েছে।

তবে শত চেষ্টা সত্ত্বেও মার্কিন অবরোধ কখনোই আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে অবরোধ, হামলা, মনস্তাত্ত্বিক চাপ, আতঙ্ক ছড়ানো, অন্তর্ঘাত, হত্যা, হত্যার চক্রান্ত কোনো কিছুই কিউবার ‘অলস’ ‘অক্ষম’ মানুষদের ভীত করতে পারেনি, দমাতে পারেনি। এর ফলে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে সব মানুষের অসীম শক্তি সব সময় সজীব, জোরদার, ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। অবরোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের ভেতর এক অসম্ভব পরিবর্তনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা এবং অব্যাহত হুমকির মধ্যে নিজেদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় রাখা, নিজেদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে সারা দুনিয়াকে জানানোর বিষয়ে তাদের কখনো ক্লান্ত দেখা যায়নি।

সে কারণে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মার্কিন অবরোধ সব সময়ই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। মার্কিন অবরোধ তুলে নেওয়ার কিউবান প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাস হয়ে এসেছে সব সময়। এই ভোটাভুটিতে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কয়েকটির বেশি ভোট পায়নি, বিরত থাকার সংখ্যাও ক্রমাগত কমেছে। ১৯৯২ সালে পক্ষে ছিল ৫৯, বিপক্ষে ৩, আর বিরত ছিল ৭১। ১৯৯৪ সালে পক্ষে ছিল ১০১, বিপক্ষে ২, আর বিরত ছিল ৪৮। ২০০০ সালে পক্ষে ছিল ১৬৭, বিপক্ষে ৩, আর বিরত ছিল ৪। এর পরের বছরগুলোতেও এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। পক্ষে ভোট বেড়েছে, বিপক্ষে ৪-এর বেশি ওঠেনি। কিউবার অবস্থান এতই স্বচ্ছ, নৈতিক ও যৌক্তিক যে যুক্তরাষ্ট্রের ধামাধরা দেশগুলোও এ ক্ষেত্রে তার বিপক্ষে ভোট দেওয়ার যুক্তি দাঁড় করাতে পারেনি।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় দানবীয় শক্তির ক্রমাগত আক্রমণ ও চক্রান্তের মুখে কিউবার টিকে থাকাই এক বিস্ময়। কিউবা শুধু টিকেই থাকেনি, পরিবেশসম্মত কৃষিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বে মডেল হয়েছে। সব নাগরিকের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করেছে। বর্ণবাদী, যৌনবাদীসহ বৈষম্য ও নিপীড়নের গোড়ায় আঘাত করেছে কিউবা। চিকিৎসা–প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনায় কিউবা এখন বিশ্বের ১ নম্বর দেশ। এই জ্ঞান ও সেবা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কিউবার প্রায় ৫০ হাজার চিকিৎসক বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। কিউবায় শিক্ষা, চিকিৎসা জনগণের অধিকার হিসেবে সর্বাধিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর এর মাধ্যমে কিউবা এ দুই ক্ষেত্রে এখন মহা সম্পদশালী যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এগিয়ে।

এখন যুক্তরাষ্ট্র সশরীরে কিউবায় হাজির। তার ইচ্ছা কিউবাকে পরিবর্তন করা। বিপ্লব–পূর্ব কিউবাই তাদের পছন্দের, যেখানে অবাধ মার্কিন বিনিয়োগ ছিল, উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করে তা ক্যাসিনো আর পতিতাবৃত্তির দেশে পরিণত করেছিল কিউবাকে। তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টাই তারা চালাচ্ছে এত বছর ধরে। তখন কিউবার বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্য-নির্যাতনের ভেতর তো বটেই, যাপন করত ভয়ংকর এক অসম্মানিত জীবন। বিপ্লব তাদের শুধু ক্ষুধা থেকে মুক্ত করেনি, দিয়েছে এক সম্মানজনক জীবন। এখন পণ্য, পুঁজি আর সমষ্টির বিনিময়ে ব্যক্তির জৌলুশ কিউবার সমাজে টোকা দিচ্ছে। বহুদিনের চেষ্টায় তার পক্ষে শক্তিও দাঁড়াচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যখন কিউবার বিরুদ্ধে চক্রান্ত-অন্তর্ঘাতে পরাজয় স্বীকার করে নতুনভাবে সেখানে প্রবেশের পথ খুঁজছে, তখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই ১ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশের লড়াই দানা বাঁধছে। বৈষম্য, নিপীড়ন, যুদ্ধ, বিশ্বজুড়ে সহিংসতার বিরুদ্ধে চিন্তা ও সক্রিয়তা মার্কিন জনগণ, বিশেষত তরুণদের নাড়া দিচ্ছে বলেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারেও শোনা যাচ্ছে সেই সব কথা, যেগুলো ফিদেল কাস্ত্রো অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন।

সুতরাং কে কাকে বদলাবে সেটা এখন বড় প্রশ্ন।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ  অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়