ব্লগার তো নন, নিরীহ সেতারবাদক!

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী
অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী

এই প্রসঙ্গটা মনে এল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর খুন হওয়ার পরের প্রতিক্রিয়াগুলো লক্ষ করে। যাঁরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, যাঁরা তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করছেন, তাঁরা বলছেন, তিনি তো ব্লগার ছিলেন না, ধর্মের বিরুদ্ধে কখনো একটি শব্দও লেখেননি, তাহলে তাঁকে কেন চাপাতি হেনে ব্লগারদের মতো খুন করা হলো? ব্যাপারটা এমন, যেন কেউ ব্লগার হলেই, ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তাকে খুন করা জায়েজ।

 তাই, অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী নিরীহ মানুষ ছিলেন, তাঁর কোনো শত্রু ছিল না, তিনি সংগীত ভালোবাসতেন, সেতার বাজাতেন—এসব গুণের বর্ণনার সঙ্গে বিলাপ চলছে। তাঁর এই সদ্‌গুণগুলো দিয়েই যেন-বা বিলাপকারীরা নিজেদের বিলাপকে যুক্তিসিদ্ধ করে নিতে চাইছেন। তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা আরও তথ্য জোগাচ্ছেন: তিনি গ্রামে গেলে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন, মসজিদ-মাদ্রাসায় দানও করতেন! তিনি তো ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য কখনো প্রকাশ করেননি, তবু কেন তাঁকে খুন করা হলো?

র‍্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত ছেলের মা-বাবাও বিলাপ করেন এই যুক্তিতেই: ‘আমাগো পোলাডা তো সন্ত্রাসী আছিল না, ওরে ক্যান মাইর‍্যা ফেললেন?’ নিরীহ কিশোর লিমন র‍্যাবের গুলিতে একটা পা হারালে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও বিলাপ করেছিলেন এই বলে: ‘আহা, বাচ্চা ছেলেটা তো সন্ত্রাসী ছিল না!’

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কারা হত্যা করেছে, আমরা জানি না। পুলিশ বারবার বলছে, হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে তাদের মনে হচ্ছে তিনি ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাতে খুন হয়েছেন। ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা কাউকে খুন করলে সেই অপরাধের প্রতিকার করতে সরকার বিশেষ আগ্রহী নয়, যদি খুন হওয়া ব্যক্তি প্রকৃতই ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এ রকম মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যে। বলা হচ্ছে, মুক্তচিন্তার নামে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি গ্রহণযোগ্য নয়, সরকার কোনোভাবে এসবের দায়দায়িত্ব নেবে না। ৭ এপ্রিল ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার নাজিম উদ্দিন দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাত ও গুলিতে নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নাজিম ব্লগে কী ধরনের লেখালেখি করতেন, তা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থাৎ, মনোভাবটা যেন এমন যে, যদি দেখা যায় নিহত যুবকটি সত্যিই ধর্মবিরোধী লেখালেখি করতেন, তাহলে তিনি তাঁর প্রাপ্য শাস্তিই পেয়েছেন।

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের পর দেখা যাচ্ছে সরকারের এই মনোভাব বা দার্শনিক অবস্থান সাধারণ জনমনকে প্রভাবিত করেছে। অথবা এ-ও হতে পারে যে এই বিষয়ে জনমনস্তত্ত্ব এ রকম বলেই সরকারের পক্ষ থেকে ও রকম অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এসব কারণেই কি অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় যেটুকু কান্না দেখছি, প্রতিবাদ সেটুকুও দেখছি না? প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী আর প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, তার একজন অধ্যাপককে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবাদ কোথায়? যেসব প্রতিবাদ মিছিল, সড়ক অবরোধ, মৌন মিছিল ও মানববন্ধন হয়েছে, সেগুলোর কোনোটাতে ৪০০-এর বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেননি। ১ হাজার ২০০ শিক্ষকের মধ্যে অংশ নিয়েছেন সর্বোচ্চ ২০০ জন!

এ কেমন নির্লিপ্ততা? কেন এই ভয়ংকর ভাবলেশহীনতা? এই নির্বিকার মনোভাব, এমন ন্যক্কারজনক অসাড়তার রহস্য কী? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কি বিশ্ববিদ্যালয় আছে? সেখানকার শিক্ষকেরা কি শিক্ষক আছেন? চতুর্থবারের মতো সহকর্মী খুনের ঘটনায়ও যেসব শিক্ষকের টনক নড়ছে না, যাঁরা প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন না, তাঁরা কি পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার শিক্ষার্থী তাঁদের একজন শিক্ষকের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে অংশ না নিয়ে থাকতে পারছেন, তাঁদের কি তারুণ্য আছে?

লক্ষ না করে পারা যাচ্ছে না যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড এ দেশেরসংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্পর্শই করেনি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দূরে থাক, শিক্ষকেরাও ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচি পালন করেননি। সারা দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংগঠিত কোনো প্রতিবাদ নেই বললেই চলে।

ফেসবুকে তানজির ইসলাম বৃত্ত নামে এক তরুণ ‘বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোমের’ কথা লিখেছেন। ব্যাপারটা এ রকম: একটা পানিভর্তি পাত্রে জীবন্ত এক ব্যাঙ খেলা করছে। পাত্রটা চুলায় তুলে দিন, চুলাটাতে আগুন ধরান। কী ঘটবে? ব্যাঙটা লাফ দিয়ে পাত্র থেকে নেমে যাবে? না। পানির তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙটাও নিজের দেহের তাপমাত্রা বাড়াতে থাকবে। এভাবে সে ক্রমে-গরম-হতে-থাকা পানির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করবে, তাপ সহ্য করে চলবে। ফলে ওই পাত্র থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বা ইচ্ছা সে বোধ করবে না।

কিন্তু পানির তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এমন মাত্রায় উঠতে থাকবে যে একটা সময় আসবে, যখন ব্যাঙটার নিজের দেহের তাপমাত্রা ওই উত্তপ্ত পানির সঙ্গে আর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে না। তার তাপ সহ্য করার ক্ষমতা শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে। তখন তার ইচ্ছা করবে লাফ দিয়ে পাত্রটা থেকে বেরিয়ে আসার। কিন্তু হায়, তখন আর তার শরীরে লাফ দেওয়ার মতো শক্তি অবশিষ্ট থাকবে না। কারণ, পানির তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের দেহের তাপমাত্রা বাড়াতে গিয়ে তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়েছে। ফলে, সে ওই ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ হতে থাকবে।

ওই তরুণ ফেসবুকার মন্তব্য করেছেন: ‘খুব সম্ভবত আমরাও ওই ব্যাঙের মতো মানিয়ে নিচ্ছি আমাদের চারপাশের সঙ্গে। সহ্য করছি সব, আর ভাবছি টিকে আছি, টিকে থাকব। আসলে আমরা সেই বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোমে আক্রান্ত। যখন বুঝব, তখন ডিসিশন মেকিংয়ের কোনো শক্তিই আর শরীরে অবশিষ্ট থাকবে না।’

ব্লগার থেকে পুস্তক প্রকাশক, তারপর নিরীহ সেতারবাদক। এরপর কে? যে ছবি আঁকে? নাটক-সিনেমা বানায়? গল্প-উপন্যাস লেখে? কিংবা স্রেফ বই পড়ে?

মশিউল আলম: সাংবাদিক।