জাদুঘরে আসুন, ঐতিহ্যকে জানুন

ইংরেজি মিউজিয়াম, যার বাংলা আমরা জাদুঘর করেছি। এই জাদুঘর আসলে কী? এর উত্তরে বলা যায়, জাদুঘর হলো জ্ঞানের আধার। জাদুঘর হলো সমাজের দর্পণ। জাদুঘর হলো একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির সংগ্রহভান্ডার। এই সংগ্রহভান্ডারের এক একটি উপাদানের দিকে তাকালে জাতির শেকড় সন্ধান করা যায়। উপাদানের গায়ে ফুটে ওঠে ঐতিহ্যের আলো। যে আলো আলোকিত করে, উদ্বুদ্ধ করে, উদ্বেলিত করে উত্তর প্রজন্মের মানুষদের। তারা জানতে পারে পূর্বপুরুষের কৃষ্টি ও কীর্তিময় সময়কে। এই কীর্তিময় সময়ে থাকে বহমান নদী, প্রকৃতি-নিসর্গ, ফুল-পাখি, মানুষ, তার আচার-আচরণ, অভিব্যক্তি, তার জীবনের ভাষণ বা জীবনগাথা, তার ব্যবহার্য নানা উপাদান, তার সুর ও স্বর। এই স্বরগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক থেকে তুলে এনে যেখানে উপস্থাপন করা হয়, সেটিই একটি সমৃদ্ধ জাতির বা একটি স্বাধীন দেশের সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালা বা সংগ্রহভান্ডার কেবল দেশের মানুষকেই অনুপ্রাণিত করে না, অনুপ্রাণিত করে বিভিন্ন জাতি বা নানা দেশের নানা শ্রেণি ও প্রকৃতির মানুষকে। এখান থেকে তারা প্রত্যক্ষ শিক্ষা লাভ করে, তাই এই একুশ শতকে জাদুঘরকে বলা হয় জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় বা গণবিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরও বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা উপাদান ধারণ করে আছে। বায়ান্নর রক্ত-সিঁড়ি পেরিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঁকের নাম একাত্তর। এই একাত্তরেই বাঙালি জাতি তার এক নদী রক্ত ঢেলে দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার সূর্যকে এনেছে। স্বাধীনতার বয়স প্রায় অর্ধশত বছরের কাছাকাছি হলেও, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রায় আড়াই হাজার বছরের। এই ঐতিহ্যের অনুসন্ধান মিলেছে উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত বেশ কিছু নিদর্শনে; যা শোভা পাচ্ছে সেখানেই জনাব হাবিবুল্লাহ পাঠানের গড়ে তোলা ছোট্ট জাদুঘরে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরেও রয়েছে এই বাংলা অঞ্চলের হাজার বছরের ঐতিহ্যিক নিদর্শন। এসব নিদর্শন নানা ধরনের। জনজীবন, বাংলাদেশের নৌকা, মৃৎশিল্প, পোড়ামাটির নিদর্শন, মূর্তি, কয়েন, অলংকার, হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম, প্রাকৃতিক সম্পদ, খাদ্যদ্রব্য, পশুপাখি, জীবজন্তু, গাছপালা, অস্ত্রশস্ত্র, ধাতব শিল্পকর্ম, পুতুল, বাদ্যযন্ত্র, পোশাক, নকশিকাঁথা, কাঠের শিল্পকর্ম, পাণ্ডুলিপি, বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা নান্দনিক চিত্রকর্ম, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যবহৃত নিদর্শন, অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের ধারাবাহিক সঠিক ইতিহাসের গৌরবময় ঐতিহাসিক নিদর্শন। আছে বিশ্বসভ্যতার অনেক নিদর্শন এবং সাম্প্রতিক কালে করা কয়েকটি দেশের নিদর্শন নিয়ে কর্নার। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে নানা প্রকৃতির নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ৮৬ হাজার। আর এর আওতাধীন আহসান মঞ্জিল, সিলেট ওসমানী জাদুঘর, চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার নিদর্শন নিয়ে মোট নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। দুঃখজনক হলেও সত্য, জায়গার অভাবে এই বিশাল সংগৃহীত নিদর্শন থেকে সামান্য অংশই দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করা যাচ্ছে। তবে আশার কথা, জাদুঘর দেখতে এখন প্রচুর দর্শকের সমাগম হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর একটি বহুমাত্রিক জাদুঘর। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ এ জাদুঘরটির প্রাচীন নাম ‘ঢাকা জাদুঘর’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য যে বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, সেই একই বছরে অর্থাৎ ১৯১৩ সালে বাংলা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির গর্বের ও গৌরবের এ প্রতিষ্ঠানটি। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে এ বছর এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি ১০২ বছরে পদার্পণ করল।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি এখন দাঁড়িয়ে আছে রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল শাহবাগে। ১৯৮৩ সালে ঢাকার নিমতলীর ছোট্ট পরিসর থেকে শাহবাগের এই বিস্তৃত পরিসরে আনা হয় জাদুঘরটিকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছায় ও পরিকল্পনায় শাহবাগের এই পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হয়। রূপান্তরিত হয় ‘ঢাকা জাদুঘর’ থেকে ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর’। বর্তমানে জাদুঘরে রয়েছে ছয়টি কিউরেটরিয়াল বিভাগ। এগুলো হলো ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগ, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ, প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ, সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগ, সংরক্ষণ রসায়নাগার বিভাগ এবং গণশিক্ষা বিভাগ। এসব বিভাগের মাধ্যমে নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণা করা হয়। পাশাপাশি নানামাত্রিক অনুষ্ঠান, বিশেষ প্রদর্শনী, স্কুল প্রোগ্রাম, সেমিনার, স্মরণীয়-বরণীয়, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ অসংখ্য কার্যক্রম।
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং বর্তমান সরকারের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অনেক এগিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে প্রায় এক লাখ নিদর্শনের ছবিসহ ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। জাদুঘরের রয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইট। এই ওয়েবসাইটে পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো ব্যক্তি পাবেন জাদুঘরের সর্বশেষ তথ্য। প্রতিনিয়ত জাদুঘরে বাড়ছে দর্শকের সংখ্যা। কারণ দর্শক তাঁদের শিকড়ের সন্ধান করতে জাদুঘরে আসেন। জাদুঘরও দর্শকদের জন্য, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য আহ্বান জানায়, ‘জাদুঘরে আসুন, নিজের ঐতিহ্যকে জানুন’। জাদুঘরে আপনার সন্তানকে নিয়ে আসুন। নিজের ঐতিহ্যকে জানতে তাদের সাহায্য করুন। কারণ তারাই তো জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার, তারাই তো বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। জাদুঘর সত্যিকার অর্থেই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের তৃণভূমি।
এ বছর আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে: ‘Museums and Cultural Landscapes’, অর্থাৎ ‘জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক স্থলভূমির দৃশ্য’ এটা আক্ষরিক অর্থে। এভাবেও বলা যায় যে জাদুঘর সংস্কৃতির পিঠের নরম রোদ। তাই আসুন, সংস্কৃতির জন্য জাদুঘরকে নিয়ে সবাই ভাবি।
শিহাব শাহরিয়ার: কবি ও জাদুঘরকর্মী।