'গণহত্যা' ও 'ইতিহাস' এক বিষয় নয়

>প্রস্তাবিত ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ’ আইনের যে খসড়া তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে নানা মত ও বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে দুই পর্বের লেখার শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো আজ।
.
.

প্রথমে শুনেছিলাম ইউরোপের হলোকাস্ট ডিনায়্যাল অ্যাক্টের (গণহত্যা অস্বীকারকরণ আইন) আদলে একটা আইন হবে, কিন্তু এখন দেখি আইনের শিরোনাম থেকে হলোকাস্ট বা গণহত্যা কথাটি সরে গিয়ে সেখানে ‘ইতিহাস’ শব্দটি জ্বলজ্বল করছে। গতকাল জানলাম আইন কমিশন তার চূড়ান্ত খসড়া সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। এতে তারা কিছু পরিবর্তন এনেছে। ১৯৪৭ পর্যন্ত না গিয়ে ‘ইতিহাস’ শব্দটি পরিহার করে ‘মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবিল’ (১ মার্চ–১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) অস্বীকারকে অপরাধ এবং সরকারি প্রকাশনার (মার্চ–ডিসেম্বর ১৯৭২) বিবরণ অস্বীকারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। প্রথম খসড়ার চেয়ে এটি উন্নত কিন্তু তাতে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি বিশেষ করে অপব্যবহারের আশঙ্কা বা আইনের প্রয়োগযোগ্যতা যথেষ্ট ত্রুটিমুক্ত হয়েছে, তা বলা যাবে না।
এতকাল আমরা পাল্টাপাল্টি বই মুদ্রণ, পুনর্মুদ্রণের অনুশীলন দেখেছি। এবার শাস্তির বিধান আসছে। প্রকারান্তরে এই আইন পাস হলে তা চিন্তা ও বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রকে আরও সংকুচিত করবে। ইতিহাসচর্চা নিয়ে পাশ্চাত্যেও তর্ক আছে। একে তারা বলে ‘হিস্টোরিক্যাল রিভিশনিজম’। এর আওতায় প্রচলিত ধারণা ও জ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। আর ঐতিহাসিক ঘটনার বিকৃতকরণ বা অস্বীকার করাকে বলে ‘হিস্টোরিক্যাল নেগেশানিজম’, একে প্রতিহত করতেই ওই আইন।
হলোকাস্ট আইনের দোহাই দেওয়া হলেও দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য পুরো সত্য তুলে ধরা হয়নি। মন্ত্রিসভা ও সংসদের সামনে সেই সুযোগ থাকবে। প্রতিটি প্রস্তাবিত বিধানের সঙ্গে হলোকাস্ট বা গণহত্যা অস্বীকারকরণ আইনের তুলনা করুন, তাহলেই সত্যটা বেরিয়ে আসবে। হলোকাস্ট আইনের বিধানাবলির সঙ্গে পারলে তুলনা করে জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রতিবেদন প্রকাশ করুন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণ অপরাধ আইনটি বাস্তবে উত্তমরূপে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। বরং আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিশেষ করে পুলিশ, যাদের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ যেন দিনে দিনে কমছে, তাদের আরও ভয়ানক বিপদে ফেলা হবে। বাক্স্বাধীনতা বা ইতিহাসচর্চার নামে কেউ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বীরত্বগাথাকে খাটো করে দেখুক, সেটা চাই না। আর সেটা বাক্স্বাধীনতা নয়। আমাদের গণহত্যার সঠিক সংখ্যা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হতে পারে, কিন্তু তা করতে গিয়ে কেউ গণহত্যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বক্তৃতা-বিবৃতি করতে পারে না। আবার আমরা এটাও মনে রাখব, আমাদের আইনে হলোকাস্ট-সংক্রান্ত কোনো বিধান নেই, সেটি কিন্তু ঠিক নয়। ১৯৭৩ সালের দণ্ডবিধিতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ অভ্যুদয়কে কোনোভাবে খাটো করলে সাত বছরের জেল আছে। এর কখনো প্রয়োগ না হওয়া কী নির্দেশ করে? এটা থাকতেও অকার্যকর থাকলে নতুন আইন তাহলে কী শূন্যতা পূরণ করবে? প্রবাসী ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রথম বছরে প্রকাশিত (১ মার্চ ১৯৭১–এ সরকার ছিল না, অথচ খসড়ায় বলা হয়েছে ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ পর্যন্ত সরকার কর্তৃক প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস) দলিলপত্র পাঠ্যপুস্তকসহ যেকোনো মাধ্যমে (তার মানে গণমাধ্যমও অন্তর্ভুক্ত) ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’কে ভ্রান্ত বা অর্ধসত্যভাভাবে উপস্থাপনকে অপরাধ বলা হয়েছে। এভাবে কি সরকারি ইতিহাস তৈরি করা সম্ভব? কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এর নজির নেই।
স্মরণ করিয়ে দিই, ২৮টি দেশ নিয়ে ইইউ, কিন্তু হলোকাস্ট অস্বীকারকে দোষণীয় করে আইন আছে মাত্র ১০টিতে। ইইউ পার্লামেন্টে দাবি উঠেছিল সব সদস্যরাষ্ট্রের জন্য একটি আইন থাকবে, তা পাস হয়নি। প্রধান কারণ হলো, সবাই মানেন যে গণহত্যাকে তাচ্ছিল্য করা দোষণীয়, কিন্তু আইন করলে তা বাক্স্বাধীনতাকে আঘাত বা সংকুচিত করতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা আর্মেনীয়দের নির্বিচারে হত্যা করেছিল। আজও তুরস্ক তাকে জেনোসাইড বলতে রাজি নয়। সম্প্রতি ইইউর মানবাধিকার আদালত এক তুর্কিকে খালাস দিয়েছেন। ওই ব্যক্তির জেনোসাইড না বলাকে তাঁরা দণ্ডনীয় মনে করেননি।
শুদ্ধ ইতিহাস বলে আদৌ কিছু কি হতে পারে? ঐতিহাসিক তথ্য জানা ও নব নব মূল্যায়নের কি শেষ আছে? লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৭৯ সালে আয়ারল্যান্ডে নিহত হওয়ার আগে ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট বইয়ের দুই দুঁদে সাংবাদিককে যে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়ে গেছেন, তা পড়ে মনে হয় যে নেহরু ও জিন্নাহ উভয়ে পরিষ্কার জানতেন পূর্ববঙ্গের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। আমরা এ ভূখণ্ডে বাংলায় কথা বলব, তা আমাদের পূর্বপুরুষদের অবিসংবাদিত নেতা নেহরু ও জিন্নাহ ১৯২৮-২৯ সালেই স্থির করেছিলেন। মাউন্টব্যাটেন বলেছেন, একদিন জিন্নাহ এসে বললেন, বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করে পাকিস্তান হলে তা তো টেকার নয়, রক্তপাত হবেই। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে মাউন্টব্যাটেন আরও বলেছেন, আমি ও ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল রাজাগোপালচারি সাতচল্লিশেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, ২৫ বছরের বেশি টিকবে না পাকিস্তান।
স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়ে একজন অবাঙালি স্বপ্নদ্রষ্টার কথা সম্প্রতি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের বই থেকে জানতে পেরেছি। পূর্ব পাকিস্তান ও আসাম নিয়ে ‘বাঙ্গিস্তান’, দক্ষিণাত্য নিয়ে ‘উসমানিস্তান’ এবং আজকের পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে ‘পাকিস্তান’ এই তিনটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ম্যাপ প্রকাশ করেছিলেন তিনি ১৯৩৩ সালেই। কেমব্রিজ-পড়ুয়া চৌধুরী রহমত আলী, যিনি পাকিস্তান ও দ্বিজাতিতত্ত্ব দুটোরই উদ্গাতা হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তাঁর এই পরিচয় আমার জানা ছিল না। ১৯৪৬ সালে, মানে দেশভাগের এক বছর আগেই প্রকাশিত ইন্ডিয়া ডিভাইড বইয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ রহমত আলীর ওই দেশভাগ ভাবনা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। রহমত আলীর বিশ্বাস ছিল ‘বাঙ্গিস্তান’কে নিয়ে পাকিস্তান করলে তা টিকবে না। আমরা একাত্তরের মার্চে ঢাকায় শিথিল কনফেডারেশন নিয়ে আলোচনা করেছি, আর তিনি ১৯৩৩ সালেই তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কনফেডারেশন হিসেবে ‘পাকএশিয়া’ গঠনের রূপরেখা দিয়েছিলেন। জিন্নাহকেও বলেছিলেন। সাতচল্লিশেই ‘বাঙ্গিস্তান’ কেন স্বাধীন হলো না, সেই দুঃখ মনে চেপে তিনি রাগ করে লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন। জিন্নাহর মৃত্যুর পরে তিনি পাকিস্তানে ফিরলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী তাঁকে বের করে দিয়েছিলেন।
দ্বিজাতিতত্ত্ব মানার অর্থ তো অন্তত বাঙালি মুসলমানের কাছে একটি মাত্র পাকিস্তান সৃষ্টি করার পরিকল্পনা ছিল না। তাহলে পাকিস্তানের গণপরিষদে কেন ভাষা আন্দোলনখ্যাত আবুল হাশিম সেই ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ গঠনের দাবিতে উচ্চকিত থাকলেন? সম্প্রতি প্রকাশিত এক পশ্চিমা লেখকের বইয়ে এর বিশেষ উল্লেখ দেখলাম। লাহোর প্রস্তাবের কথা বলতেই জিন্নাহ ও তাঁর সতীর্থরা বললেন, ওটা টাইপের ভুল ছিল। ত্বরিত নথিপত্র ঘেঁটে প্রমাণ মিলল যে সেটা ভুল নয়, সুচিন্তিত ছিল। জিন্নাহ তখন বললেন, এখন তো আর করার কিছুই নেই, যা বলার পাকিস্তানের গণপরিষদে বলবেন।
যা-ই হোক, আমরা অন্তত মানব যে ১৯৪০ সালটাও আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে একটা ঐতিহাসিক মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে। তাই ‘মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র’ বা ‘ঘটনাবিল’ ঠিক করা এবং তাকে কোনো বিশেষ দিনক্ষণ বা তারিখ দিয়ে বাঁধার দরকার তো দেখি না। শত ফুল ফুটতে দাও।
ইতিহাস নিয়ে গুণীজনের নানা মত। জর্জ অরওয়েলের এই কথাটির খুব চল আছে: ‘যিনি অতীত নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করেন। যিনি বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করেন। আমি ইয়েলের ইতিহাসবিদ জন
লিউস গেডিসকে ধার করে বলব, রিভিশিনোইজম একটি স্বাস্থ্যকর হিস্ট্রিওগ্রাফিক্যাল প্রক্রিয়া, রিভিশনিস্ট নিজেরও তার বাইরে থাকা উচিত নয়।’ শেষ করব ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ের ক্রিস্টোফার হিচিনসকে উদ্ধৃত করে। বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য হিচিনস কিসিঞ্জারের বিচার দাবি করে গেছেন। হিচিনস বলেন, ‘এর থেকে বেশি হাস্যকর ও অবমাননাকর আর কী হতে পারে, যখন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল বা যাঁরাই আমাদের প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস পুনর্লিখনের স্পর্ধা দেখান। এটা কি সম্ভব তাঁরা তাঁদের বীতরাগ বা মূর্খতা দিয়ে থমাস জেফারসনের (যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা) নাম মুছে সেখানে ধর্মভিত্তিক কারও নাম, যাঁরা ইতিমধ্যেই অপাঙ্ক্তেয়, তাঁদের নাম
বসিয়ে দেবেন? যদি সেটাই ঘটে, তাহলে আসুন, আমরা উল্লাসের সঙ্গে তাঁদের ভেংচি কাটি আর মুখের ওপর বলে দিই, তোমরা মিথ্যাবাদী।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]

আরও পড়ুন: