ঢাকার যানজট মোকাবিলায় কার্যকর উপায়

>
বিয়র্ন লোমবোর্গ
বিয়র্ন লোমবোর্গ
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ প্রকাশ করা হলো ষষ্ঠদশ নিবন্ধটি।

ঢাকা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালে যেখানে নগরটিতে মাত্র ৩০ লাখ জনসংখ্যা ছিল, সেখানে আজ জনসংখ্যা বেড়ে দেড় কোটির ওপরে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যার এই নজিরবিহীন বৃদ্ধির ফলে ঢাকা নগর টোকিও, সাংহাই, মুম্বাই অথবা অন্য সব প্রধান নগরের তুলনায় বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে।

রাজধানীর ক্রমোন্নতি আংশিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করে, যা বছরে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে বেড়েছে। তবে উন্নতি হলেও শহরের পরিবহনব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী? এ ব্যাপারে ‘বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ’ প্রকল্প সমাধান দিয়েছে। কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার এবং ব্র্যাক-এর যৌথ অংশীদারত্বের এই প্রকল্প, এই দেশ, অঞ্চল এবং সারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ডজন খানেক অর্থনীতিবিদকে নিয়োজিত করেছে যানজট থেকে শুরু করে শিক্ষা এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সমস্যাগুলোর সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিময় সমাধান নিয়ে গবেষণা করার জন্য। এর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ কীভাবে এর উন্নয়ন প্রচেষ্টার পেছনে ব্যয়িত প্রতি টাকায় সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন করতে পারবে, তা খুঁজে বের করা।
পরিবহন পরিকল্পনাকারী এবং দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রবার্ট গালার তাঁর গবেষণায় ঢাকার ভবিষ্যৎ পরিবহনব্যবস্থার জন্য বিকল্প কয়েকটি পদ্ধতির সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করেছেন। ঢাকার বর্তমান যানজটের পেছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করছে। প্রথমত, বিগত দশকগুলোতে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অভাব এবং সরকারি পরিবহনের ঘাটতির কারণে ব্যক্তিগত গাড়ির
ওপর অতি-নির্ভরতা। যদিও শহরে সরকারি গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ৩৩ গুণ বেশি আছে, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ব্যক্তিগত গাড়ি মাত্র ১৩ শতাংশ যাত্রীর পরিবহনের ব্যবস্থা করে আর বাস ৪৯ শতাংশ যাত্রীর দায়িত্ব নেয়।
বর্তমানে ঢাকার যানবাহনের গড় গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা যদি বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকে, গণপরিবহনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিনিয়োগ ছাড়াই ২০৩৫ সাল নাগাদ গড় গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৭ কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে, যা প্রায় হাঁটার মতো ধীরগতির।
২০১৪-১৫ সালে সরকার একটি রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) অনুমোদন করে, যাতে পাঁচটি পাতাল রেললাইন, দুটো দ্রুতগতির বাস রুট এবং ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমান সড়ক নেটওয়ার্কের দ্বিগুণ। এতে ছয়টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং তিনটি রিং রোড অন্তর্ভুক্ত আছে। আগামী ২০ বছরে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় হবে প্রায় ৩ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা।
‘বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ’-এর গবেষণায় দেখা গেছে, আরএসটিপি বাস্তবায়নে সরকারি খরচের তুলনায় পরবর্তী দুই দশকে ঢাকার পরিবহন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বেশি পরিমাণে হবে। সব ব্যক্তিগত পরিচালনা ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে যেমন জ্বালানি, চালকের বেতন, গ্যারেজে রাখার খরচের পাশাপাশি নতুন গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশার প্রকৃত ক্রয় খরচ ধরে ব্যক্তিগত খরচ হতে পারে প্রায় ৬ লাখ ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা সরকারি খরচের দ্বিগুণ।
আরএসটিপি ঢাকার যানবাহনের গতিপ্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করবে। এটি ঢাকার যানবাহনের গতিকে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়াতে পারে, যে গতি ২০১০ সালের দিকে শেষ দেখা গিয়েছিল। যাতায়াতের ক্ষেত্রে সময় সাশ্রয়ের দিক থেকে লাভের সবচেয়ে বড় অংশটি আসতে পারে। বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজের গবেষণায় দেখা যায়, আরএসটিপি বাস্তবায়নে ব্যয়িত প্রতি টাকা এ ক্ষেত্রে প্রায় তিন টাকার সমপরিমাণ কল্যাণ সাধন করবে।
তবে খসড়া পরিবহন পরিকল্পনায় ৩ লাখ ৬০ হাজার অতিরিক্ত গাড়ি রাস্তায় নামানোর কথা বলা হয়েছে, যা অনেক বেশি পরিমাণে জায়গা দখল করবে—এসব গাড়ি শুধু পার্ক করার জন্যই ৩ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার জায়গার প্রয়োজন হবে, যা গুলশান এবং বনানী আবাসিক এলাকার মিলিত আয়তনের প্রায় সমান।
গালার একটি বিকল্প উপায় পরীক্ষা করে দেখেছেন, যা বাস ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোতে বৃহত্তর বিনিয়োগের ওপর দৃষ্টিপাত করে, যা জায়গা-দখলকারী বহুসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, সাইকেল এবং রিকশার প্রয়োজনকে প্রশমিত করবে। এই বিকল্প উপায় বাস্তবায়ন করা গেলে খসড়া পরিবহন পরিকল্পনার আওতায় একই পরিমাণ সরকারি খরচে আরও অতিরিক্ত ৯ হাজার বাস পাওয়া যাবে।
এ ছাড়া ২০৩৫ সাল নাগাদ মাত্র ১ লাখ অতিরিক্ত ব্যক্তিগত গাড়ি, যা আরএসটিপির প্রস্তাবের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম। বিকল্প উপায়টি তুলনামূলকভাবে অনেক কম রাস্তা দখল করবে, যানজট কমাবে এবং যানবাহনের গড় গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটারে নিয়ে আসবে। এতে করে যাত্রীদের আরও বেশি সময় সাশ্রয় হবে। যানজট হ্রাস এবং পরিবহনব্যবস্থায় খরচ কমিয়ে আনার সম্মিলিত সুবিধার অর্থ হবে, ব্যয়িত প্রতি টাকা প্রায় ছয় টাকার সমপরিমাণ কল্যাণ সাধন করবে।
ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।