মাননীয় সাংসদেরা যদি ক্ষ্যামা দেন...

.
.

সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী, যিনি বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্ট ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি, ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি নবম সংসদে ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন, ২০১০’ শিরোনামে যে বিল এনেছিলেন, তা আলোর মুখ দেখেনি। নবম সংসদে বিরোধী দল ছিল বিএনপি। তারাও বিলটি পাসের ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখায়নি। বিএনপির সাংসদেরা হয়তো ভেবেছিলেন, পরেরবার তাঁরাই ক্ষমতায় আসছেন। তাহলে জেনেশুনে কেন এই ‘বিষ’ পান করবেন? আচরণবিধি থাকলেই তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতাও থাকে।
সাবের হোসেন চৌধুরী সম্ভবত নবম সংসদের সদস্যদের সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট ও জরিপ দেখে সাংসদদের আচরণবিধির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। বিলটিতে সাংসদদের নৈতিক অবস্থান, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ও আয়-রোজগারের তথ্য, উপহার নেওয়া, সরকারি সম্পদের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশনা ছিল এবং বিষয়গুলো দেখার জন্য একটি নৈতিকতা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল, যারা দোষী সাংসদদের শাস্তির সুপারিশ করতে পারত। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০১১ সালের ২৪ মার্চ বেসরকারি সদস্যদের বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি পাস করার সুপারিশও করেছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই। তবে সে সময় সাংসদদের আচরণ নিয়ে ভেতরে-বাইরে আলোচনা কম হয়নি। ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর নবম জাতীয় সংসদের সাংসদদের নিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এই জরিপে বলা হয়েছিল, সংসদের ৯৭ শতাংশ সাংসদ সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা আছে। তৎকালীন সাংসদেরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, সংসদ ও গণতন্ত্রকে হেয় করার জন্যই টিআইবি এই জরিপ করেছে।

আর দশম সংসদের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়, তাতে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনটি যেমন একতরফা হয়েছে, তেমনি এর মাধ্যমে গঠিত সংসদও প্রায় একদলীয় বা একজোটীয় হয়ে পড়েছে। ১৫৪ জন নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অপর শরিকেরা নিজেদের সরকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। আর জাতীয় পার্টি নিজেকে বিরোধী দল দাবি করলেও তারা একই সঙ্গে সরকারের অংশীদার। ৭০ অনুচ্ছেদের খড়্গ নিয়ে তাদের পক্ষে প্রকৃত বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

সে ক্ষেত্রে ‘বিরোধী দলবিহীন’ দশম সংসদের সাংসদেরা যে ধরাকে সরা জ্ঞান করবেন, সে ব্যাপারে কারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের কারও কারও আচরণ মাস্তা​িন​​র পর্যায়ে চলে গেছে। কথার চেয়ে হাত ব্যবহারেই তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এমনিতেই অধিকাংশ সাংসদ নিজেদের নিজ নিজ এলাকার ‘সম্রাট’ মনে করেন। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তাঁদের (সাংসদদের) হুকুম মেনে চলতে হয়। হুকুম না মানার পরিণতি কী হয়, সাম্প্রতিক দুটি উদাহরণই যথেষ্ট বলে মনে করি।

প্রথমটি ঘটিয়েছেন কক্সবাজারের বাঁশখালীর সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ৪ জুনের ইউপি নির্বাচনের আগে তিনি নির্বাচনী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের হাতে একটি তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এঁদের নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর এই হুকুম পুরোপুরি না মানায় তাঁর ওপর চড়াও হন চৌধুরী সাহেব। তিনি ইউএনও অফিসে তাঁকে ডেকে এনে বেয়াদবির শাস্তি হিসেবে চড়-থাপ্পড় মারেন। কাজটি করেন ঘরের দরজা বন্ধ করে, যাতে কোনো সাক্ষী না থাকে। এরপর ঘর খুলে দিলে সাংসদের অনুসারীরাও তাঁকে এলোপাতাড়ি কিল, ঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন।

সাংসদ কেন তাঁর ওপর চড়াও হলেন, তা জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এমপি সাহেব বাঁশখালীতে তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে আমাকে চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। আমি তাঁকে বলি, স্যার, জনগণ ভোট দিলে আপনার প্রার্থী জিতবে। আমি কীভাবে আপনার প্রার্থীকে জেতাব? এরপর আমার ওপর চড়াও হন তিনি।’

তবে সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করছেন, ‘জাহিদুল বেছে বেছে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের নির্বাচনী দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি অনেক অভিযোগ পেয়ে তাঁকে ইউএনও সাহেবের কার্যালয়ে ডেকে পাঠাই।’ তিনি মারধরের ঘটনাও অস্বীকার করেন। কিন্তু বাঁশখালীর বাহারছড়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা এম বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরীর কথায়ই বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে তিনি পছন্দের ব্যক্তিদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমাকে হারানোর জন্য এমপি সাহেব নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর করলেন।’ সাংসদ যে ইউনিয়নের তালিকা নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী।

শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ওই সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও প্রতিকার পাওয়া যাবে, তা কেউ মনে করেন না। মহাপ্রতাপশালী সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হিম্মত কার আছে? ইতিমধ্যে জাহিদুল ইসলামকে বাঁশখালী ছাড়তে হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনী কাজে বাধা দেওয়ার দায়ে সাংসদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। নানা তুচ্ছ ঘটনায়ও যদি দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসতে পারে, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তাকে মারধরের কারণে কেন নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নিতে পারলেন না? কেন গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হলো না? তিনি সাংসদ না হয়ে সাধারণ নাগরিক হলে সরকার কী করত?

সাংসদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করে যে কোনো ফল পাওয়া যাবে না, তা বোঝা গেল বাঁশখালীতে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্যের বক্তব্যে। যখন সাংসদ সদলবলে জাহিদুল ইসলামকে মারধর করছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ওই পুলিশ সদস্য উল্টো তাঁর কাছে কৈফিয়ত দাবি করে বললেন, কেন তিনি এমপি সাহেবের কথা শুনলেন না?

নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় যেখানে উচ্চ আদালত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন, সেখানে স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁর ফাঁসি হলেও তিনি ক্ষমা চাইবেন না। এটি কী আদালতের প্রতি চ্যালেঞ্জ নয়?

 প্রথমে সেলিম ওসমান বলেছিলেন, ওই শিক্ষক স্বেচ্ছায় কান ধরে ওঠবস করেছেন। কিন্তু শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত যখন বললেন, তাঁর দুই গালে চড় মেরে সাংসদ তাঁকে কান ধরে ওঠবস করাতে বাধ্য করেছেন, তখন ওই সাংসদ বললেন, শিক্ষক ধর্মের অবমাননা করেছেন। এরপর বললেন, শিক্ষক হিসেবে নয়, নাস্তিক হিসেবে তিনি তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন। সেলিম ওসমান একজন সাংসদ হয়ে নাস্তিক আর ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর অর্থ জানেন না! যাঁরা ইসলামের অনুসারী নন, তাঁরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হতে পারেন, নাস্তিক নন।

 গত ১৩ মে বন্দরনগরীর পিয়ার সাত্তার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনায় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের পাশাপাশি অন্তত পাঁচজন মন্ত্রী ঘটনার প্রতিবাদ জানালেও ওসমান পরিবার এতটুকু লজ্জিত নয়। বরং তাঁরা সরকারের মন্ত্রী, সরকারি দলের নেতাসহ প্রতিবাদী মানুষের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে খেপিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেননি। ২০১৩ সালের ৬ মে কাঁচপুরে যাঁরা তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, তাঁদেরই ব্যবহার করা হয়েছে ধর্মের অবমাননাবিরোধী কথিত সমাবেশে। এর আগে সাংসদ শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে দুটি ইউনিয়নের নিরাপত্তা ইনচার্জ এএসপি মো. বশিরউদ্দীন কেন্দ্র দখলে বাধা দিলে ওসমান তাঁকে টেলিফোনে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন ও হুমকি দিয়েছিলেন। শঙ্কিত এএসপি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন।

সেদিনের নারায়ণগঞ্জ ও আজকের বাঁশখালী—দুটি ঘটনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা লাঞ্ছিত হয়েছেন। আর সরকার নীরব।

তবে দশম সংসদের সাংসদদের কাণ্ডকীর্তি এখানেই শেষ নয়। এই সংসদে টাঙ্গাইল-৪ থেকে নির্বাচিত আমানুর রহমান খান রানা নিজ দলেরই আরেক নেতা ফারুক হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হিসেবে এখন পলাতক। আদালতের নির্দেশে তাঁর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। কিন্তু বাড়িঘরে তেমন কিছুই পায়নি পুলিশ। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা এতই গরিব! এই সাংসদের বিরুদ্ধে আদালত ব্যবস্থা নিলেও সংগঠন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি।

২০১৫ সালের ২ অক্টোবর একটি শিশুকে গুলি করে আহত করেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন। তিনি এখন জামিনে আছেন। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সাংসদ ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন তাঁর নিজ দলের সমর্থকদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেন বলে অভিযোগ আছে। গত বছরের ৯ মে সিলেটের এক অনুষ্ঠানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে চাবুক মারার ইচ্ছা প্রকাশ করেন সিলেট-৩ আসনের সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস। সাংসদের নামের জায়গায় ভুল করে অন্যের নাম উচ্চারণ করায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম নবারুণ উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ফখরুল ইসলামকেও লাঞ্ছিত করেছিলেন ওই সাংসদ। বরগুনার একজন সাংসদের নির্দেশে একটি সালিসে এক গৃহবধূর মাথায় বিষ্ঠা ঢেলে দেওয়া হয়। ময়মনসিংহে একজন সাংসদের নির্দেশে এক কলেজশিক্ষককে দিগম্বর করে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছিল। কলেজ চত্বরের গাছ কাটার অভিযোগে রানীশংকৈল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে চড় মারেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সাংসদ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। ট্রেনে ডিলাক্স রুমের টিকিট না পাওয়ায় স্টেশন মাস্টার আবদুর রশিদকে মারধর করেন পাবনা-৪ আসনের সাংসদ শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। একই দিনে তিনি সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রহরী আমির আফজাল আলীকেও মারধর করেন। খুলনা-১ আসনের সাংসদ ননী গোপাল মণ্ডলকে অতিথি না করায় তাঁর হাতে দাকোপ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জয়ন্তী রানী সরদার লাঞ্ছিত হন। কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদি এ পর্যন্ত কতজনের গায়ে হাত দিয়েছেন, তার হিসাব নেই। প্রকৌশলী থেকে শিক্ষক কেউ বাদ পড়েননি।

দেশে এখন আইনের শাসন নয়, সাংসদদের শাসন চলছে। তাঁরা যা বলবেন, সেটাই মানতে হবে। শেরপুরের এক সাংসদ তো মন্ত্রিসভার একজন জ্যেষ্ঠ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদ্‌গার করেছেন। একেই বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।

 নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অধ্যায়ে বলেছিল, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে। দশম সংসদ তারই ধারাবাহিকতা। সাংসদদের এই ঠেঙানি-মাস্তানি যদি রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতার নমুনা হয়, তাহলে সবিনয়ে একটি কথাই বলতে হয়, ‘এমন সাংসদ আমরা চাই না।’

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক