আওয়ামী লীগের ভেতরে এ কোন লীগ?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

৫ জুন কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল যাচ্ছিলাম। প্রেসক্লাবের সামনে যেতেই দেখি, একটি মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে বক্তারা উচ্চ নিনাদে শিক্ষা আইন ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। তাঁরা পাঠ্যবই থেকে সব হিন্দু লেখকের লেখা বাতিল করার দাবি জানান। ভাবলাম, এটি নিশ্চয়ই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের মৌলবাদী কোনো দল কিংবা মাওলানা আহমদ শফীর হেফাজতে ইসলামের কাজ।
কিন্তু আরও কাছে যেতে চোখে পড়ল বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের ব্যানার। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী ওলামা লীগের নেতারা যা বললেন, তার সারাংশ হলো, ৯৮ শতাংশ মুসলমানের দেশে হিন্দুয়ানি ও নাস্তিক্যবাদী শিক্ষা চলবে না। নাস্তিক্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী পাঠ্যসূচি, কুফরি শিক্ষা আইন-২০১৬ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। বাজেটে শুধু হিন্দুদের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। সবকিছুতেই মুসলমানদের জন্য ৯৫ শতাংশ সংরক্ষণ করতে হবে।
জামায়াত–হেফাজতের অসমাপ্ত কাজটিই ওলামা লীগ নিজের কাঁধে নিয়েছে। ওলামা লীগ নিজেকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ও বিপদের বন্ধু বলে দাবি করে। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ওলামা লীগের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি দাঁড়িয়েছে এমন যে তাঁরা কম্বল ছাড়লেও কম্বল তাদের ছাড়ছে না।
ওলামা লীগের পরিসংখ্যানটি লক্ষ করুন। একবার বলেছে, ৯৮ শতাংশ মুসলমানের দেশ। আরেকবার বলেছে ৯৫ শতাংশ মুসলমানের দেশ। কোনো হিসাবই ঠিক নয়। সরকারি হিসাবেই দেশে এখনো ৯ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু আছে। আধুনিক যুগে কোনো দেশ কেবল ধর্মের বিচারে চিহ্নিত হয় না। চিহ্নিত হয় সেখানে বসবাসরত মানুষের ভাষা, জীবনাচরণ, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া, ধর্মাচরণ—সবকিছু দিয়ে।
বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ওলামা লীগ আজ ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা চালুর দাবি করছে। সে ক্ষেত্রে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালে যদি কেউ হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থার দাবি জানায় কিংবা আমেরিকায় খ্রিষ্টানীয় শিক্ষাব্যবস্থার, তখন ওলামা লীগ কি তা মেনে নেবে? ওসব দেশে বসবাসরত মুসলমানরা তখন কী হিন্দুয়ানি কিংবা খ্রিষ্টানীয় শিক্ষা গ্রহণ করবে? ভারতে কোনো কোনো রাজ্যে সেই অালামত শুরু হয়ে গেছে। এ ধরনের উদ্ভট দাবি সব দেশের মৌলবাদীরাই করে থাকে।
ওলামা লীগের সব রোষ গিয়ে পড়েছে শিক্ষামন্ত্রীর ওপর। কারণ, তিনি একসময় বামপন্থী রাজনীতি করতেন। ডানপন্থীরা বামপন্থীদের ভয় পাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেও একটি অংশ বামপন্থার আতঙ্কে ভুগছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা সম্প্রতি ঘরোয়া আলাপে বলেছেন, এবারে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের মূল লক্ষ্য হবে নাকি নেতৃত্ব থেকে সাবেক কমিউনিস্টদের খেদানো। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে আওয়ামী লীগ সরকারে যাঁদের ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল, তাঁরা হয় সাবেক বামপন্থী, নাহয় অন্য দলের।
কেবল শিক্ষানীতি বা শিক্ষা আইন বাতিল নয়, আওয়ামী ওলামা লীগের দাবির বহরটি বেশ দীর্ঘ। তাদের দাবি, মুসলিম দেশে প্রধান বিচারপতি পদে কোনো অমুসলমানকে বসানো যাবে না। তারা জানে না বাংলাদেশের অনেক আগে পাকিস্তানে রানা ভগবান দাস নামে একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রধান বিচারপতি পদে আসীন ছিলেন কয়েক বছর আগেই। ওলামা লীগের দাবি, পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা যাবে না। এটি নাকি ইসলামবিরোধী। কোনো উৎসব পালনের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা জানে না যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে মহাজাঁকজমকের সঙ্গে ‘নওরোজ’ উদ্যাপন করা হয়। ওলামা লীগ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে হিন্দু তোষণের অভিযোগ এনেছে। এই অভিযোগ কতটা তথ্যভিত্তিক, কতটা উদ্দেশ্যমূলক, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে সংখ্যালঘু বিচারক আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। জাতীয় সংসদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব হলে অন্তত ৩০ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসার কথা। আছেন ১০–১২ জন। সাধারণত বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা থেকে সংখ্যালঘুরা আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের দাবি করে থাকেন। কিন্তু সংখ্যাগুরুর পক্ষে এই দাবি তোলার পেছনে নিশ্চয়ই বদ মতলব আছে।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একবার এমন দাবি করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ওলামা লীগের সাংগঠনিক কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শিক বন্ধনটা স্পষ্ট।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রয়াত লেখক আহমদ ছফা ‘পাকিস্তানের শিক্ষানীতি’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ওই প্রবন্ধে তিনি পাকিস্তানবাদী শিক্ষার অসারতা তুলে ধরে লিখেছিলেন, বর্তমান জগতে বাঁচার বাস্তব দাবিই শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উপজীব্য হওয়া উচিত ছিল। ইসলামি, খ্রিষ্টীয় বা হিন্দুয়ানী বলে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা এ যুগে অচল এবং একেবারে অকেজো। তবু পাকিস্তানের কর্তারা শিক্ষার সঙ্গে ধর্মকে এমনভাবে জুড়ে দিলেন, মনে হবে যন্ত্র-ঘর্ষরিত জগতে বাস করেও তাঁরা যেন মধ্যযুগের খনি খনন করে আদিম অন্ধকার সমাজজীবনে ছড়িয়ে দেওয়ার কাপালিক ক্রিয়ায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। (রক্তাক্ত বাংলা, মুক্তধারা, আগস্ট, ১৯৭১)।
আমরা ধারণা করি, সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মা ওলামা লীগ নামের সংগঠনটির ওপর ভর করেছে। সেক্যুলার আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে ওলামা লীগ সেসব দাবিই পেশ করছে, যা একসময় মুসলিম লীগ করত। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান ভেঙে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলেও এদের মনোজগতে পাকিস্তান রয়েই গেছে।
নতুন শিক্ষা আইন সম্পর্কে ওলামা লীগ ও তাদের সমর্থকেরা যেসব কথাবার্তা বলেছে, তা যেমন আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতির পরিপন্থী, তেমনি সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শিক্ষা আইনে বলা হয়: ‘যেহেতু নিরক্ষরতা দূরীকরণ, আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান, একীভূত ও জীবনব্যাপী শিক্ষা এবং একই পদ্ধতির সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে....সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।’ (সূত্র: সংসদে উত্থাপিত শিক্ষা বিল ২০১৬)
ওলামা লীগের এই দাবির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার আশ্চর্য মিল আছে। হেফাজতও ২০১০ সালের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি জানিয়েছিল। নারীনীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। এখন ওলামা লীগ কেবল শিক্ষানীতি বা আইনই বাতিল চাইছে না, পাঠ্যপুস্তক থেকে সব হিন্দু/অমুসলিম লেখকের লেখা বাদ দিতে বলছে। কী ভয়ংকর দাবি! ওলামা লীগের কথা মেনে নিলে নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাসহ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা পড়তে পারবে না। বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ মনীষীর জ্ঞানভান্ডার থেকে বঞ্চিত হবে। এটি তো একটি জাতিকে মূর্খ করে রাখার হীন প্রয়াস।
আওয়ামী লীগের নেতারা হেফাজতকে চিহ্নিত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ও আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বিরোধী শক্তি হিসেবে। কিন্তু তাদের নাম ও অফিস ব্যবহার করা ওলামা লীগের কাজকর্ম তো তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। হেফাজত আওয়ামী লীগ সরকারের নারীনীতি ও শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ২০১৩ সালে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়েছিল। এখনো সভা–সমাবেশ করছে। তাদের সঙ্গে ওলামা লীগ যুক্ত হয়ে কাকে সহায়তা করছে?
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ওলামা লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারা তো আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করছে। তাহলে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন?
অনেকে মনে করেন, জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতির সঙ্গে ভারসাম্য তৈরি করতেই আওয়ামী লীগ একসময় ওলামা লীগকে কাজে লাগিয়েছে। এখন যা বুমেরাং হচ্ছে।
২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের তৃতীয় তলায় বাংলাদেশ ওলামা লীগের নামফলকটি এখনো আছে। তবে কারা এর হকদার তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইতিমধ্যে ওলামা লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইলিয়াস হোসাইন বিন হেলালী ও মো. দেলোয়ার হোসেন। অপর ভাগে আছেন আখতার হোসাইন ও আবুল হাসান। আরও মজার বিষয় যে তাঁরা একে অপরকে বিএনপি-হেফাজতের দালাল ও জঙ্গিদের সহযোগী বলে গালাগাল করেন।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়: আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে না থাকলেও কয়েকজন মন্ত্রী ও দলের কিছু কেন্দ্রীয় নেতার ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা আওয়ামী ওলামা লীগ নামে দুটি গ্রুপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময়ে উভয় গ্রুপের কিছু কর্মসূচিতে দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে উপস্থিত থাকতেও দেখা যায়।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ‘লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মূলনীতি ও উন্নয়ন দর্শন’ অংশে বলা হয়েছে, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত সংবিধানে বিধৃত চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সকল ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভীষ্ট লক্ষ্য।’
প্রশ্ন হলো, ওলামা লীগকে সঙ্গে নিয়েই আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা কায়েম করতে চান? তাহলে জামায়াত বা হেফাজতের কী দোষ? জামায়াতে ইসলামী কিংবা হেফাজতে ইসলাম যেই কথিত ধর্মীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার খোয়াব দেখে, ওলামা লীগও তা-ই। তাদের মধ্যে নেতৃত্বের কিংবা ভাগ–বাঁটোয়ারার ফারাক থাকলেও রাজনৈতিক চিন্তার ফারাক নেই।
আওয়ামী লীগের সহযোগী বলে দাবিদার ওলামা লীগ প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। তাও এমন সময়, যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের ওপর জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী একের পর এক আক্রমণ চালাচ্ছে, তাদের খুন করছে।
এই দুঃসাহস তারা কোথায় পেল? সেক্যুলার আওয়ামী লীগের ভেতরে এ কোন লীগ?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]