আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি

দ্বিতীয়ত এটা আমাদের বুঝতে হবে যে এটা একটা জাতীয় সমস্যা, জাতীয় নিরাপত্তাজনিত সমস্যা। বিষয়টিকে সেভাবে চিহ্নিত করে ও বিবেচনায় নিয়ে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। এটা করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একটা ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক সংলাপের দরকার আছে। যেখানে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি থাকবেন। কারণ, সমস্যাটা শুধু দলের বা সরকারের নয়। এটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা এবং সেভাবেই অনুধাবন করতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বর্তমানে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, আমরা তার সাময়িক সুফল পাচ্ছি। সুফলগুলো সাময়িক। এটাকে বেশি দিন ধরে রাখার জন্য যে ধরনের কাউন্টার টেররিজম আর্কিটেকচার জাতীয় পর্যায়ে থাকা দরকার, সেটা এখন পর্যন্ত আমরা তৈরি করতে পারিনি। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গি হামলা একটা প্রক্রিয়ার অংশ। প্রক্রিয়াগুলোকে যদি বের করে পুরোপুরি বিশ্লেষণ না করি, তাহলে শুধু শেষ পর্যায়ে পদক্ষেপ নিলে সুফল পাব না। এটা কোনো পুলিশি সমস্যা নয়; এটা একটা ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। যেটার ভেতরে শুধু রাষ্ট্রের কিছু সংগঠন নয়, ব্যাপক ভিত্তিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের সংগঠনের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। কিন্তু সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত আমরা দেখতে পাইনি।

এ বিষয়ে গভীরভাবে গবেষণার প্রয়োজন আছে, তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন আছে। কেবল ওপরে ওপরে মলম লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে গেলে হয়তো সাময়িকভাবে সমাধান হবে। কিন্তু সমস্যা থেকে যাবে। ২০০৭ সালে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসির পর সংগঠনটি স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। তারা এখন নতুন আকারে, আরও প্রবল আকারে এসে হানা দিয়েছে। তাই বলতে চাই, কেবল কাউন্টার র‍্যাডিকালাইজেশন স্ট্র্যাটেজি থাকলে চলবে না, আমাদের এখানে ডি-র‍্যাডিকালাইজেশনের খুব প্রয়োজন আছে। গুলি করে মেরে এটা বন্ধ করা যাবে না। তাদের ওই উগ্র মতাদর্শ থেকে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনঃপ্রবেশ করার পথ খুঁজে বের করতে হবে।

আমাদের জেলখানাগুলোর ওপর সঠিক নজর দেওয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন সমীক্ষায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন কারাগারেও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ  হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এমনকি জেলখানার ভেতরে বসে জঙ্গিনেতারা বিভিন্ন পন্থায় বাইরে হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করিয়েছেন, এমন ঘটনাও আছে। মধ্যম বা নিম্ন পর্যায়ের জঙ্গি ধরা পড়ে জেলখানায় গিয়ে কয়েক বছর পর বড় জঙ্গি হয়ে বেরিয়ে আসে। কিছু অনুসারীও নিয়ে আসে। এসব বন্ধ করতে গেলে কারাগারগুলোর ওপর নজর দিতে হবে। কারাগারেও ডি-র‍্যাডিক্যালাইজেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা আছে।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাইবার র‍্যাডিক্যালাইজেশন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে যোগাযোগগুলো হচ্ছে তার মাধ্যমে যে ধরনের উগ্র মতাদর্শ প্রচার হচ্ছে, তার শিকার হচ্ছে বর্তমান শহুরে, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের তরুণেরা। এই পথগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। সাইবার র‍্যাডিক্যালাইজেশন বন্ধ করার জন্য যে পথগুলো আছে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বর্তমানে যে ধরনের গোয়েন্দা নজরদারি করা হয়, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই ‘পলিটিক্যাল সার্ভিল্যান্স’। এ ধরনের গোয়েন্দা নজরদারি দিয়ে ইন্টারনেটে জঙ্গি কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। এ জন্য বহুমুখী কর্মকৌশল ও প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের কাউন্টার ন্যারিটিভ দিতে পারব।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন জঙ্গিবিরোধী তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করে, তখন একটা প্রবণতা থাকে আইন লঙ্ঘনের। এর একটা স্বল্পমেয়াদি ফল হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইন মানার বিষয়ে বেশি সতর্ক থাকা উচিত, কারণ এটাই জঙ্গিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তফাত।

এ ছাড়া আমাদের দেশে একধরনের প্রবণতা লক্ষ করি যে আমরা অল্পতেই তুষ্টি লাভ করতে চাই। বর্তমানে আমরা একই ধরনের আত্মতুষ্টির দিকে এগোচ্ছি বলে আমার ভয় হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে গোপন জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো ঢিলেঢালা থাকে। এক-দুজন নেতাকে ধ্বংস করলে এরা নিঃশেষ হয় না।

মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মনিরুজ্জামান: প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ।

আরও পড়ুন