আমার রশীদ মামা

আমার একমাত্র মামা, যাকে পরিচিতরা ‘চান’, আর অন্যরা ভালো নাম রশীদ খান নামে চেনে। এই সরল-সহজ, শিক্ষিত মানুষটি অনাত্মীয় মানুষের কাঁধে চড়ে জুরাইনের কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী—আসবেই, কিন্তু কারও মৃত্যু যেন আমার মামার মতো না হয়। সে জন্য মহান দয়াময়ের কাছে আমি আকুল আবেদন করছি! নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ইব্রাহিমপুরের খান বাড়ির তিন বোনের একমাত্র ভাই সে। নানা কলকাতায় প্রেসের মালিক থাকায় পয়সার কমতি ছিল না। একমাত্র ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পিছপা হননি। মামা বিএ, এলএলবি, এমএ এবং হোমিওপ্যাথি পাস করা ডাক্তার! এ রকম শিক্ষিত একটি ছেলেকে নানা-নানি বিয়ে করাতে পারলেন না। বিয়ের কথা উঠলে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতেন, নিজের চলে না, বউকে খাওয়াব কোথা থেকে। অথচ মামা সরকারি অফিসের বড়কর্তা ছিলেন।

সারাটা জীবন শুধু মানুষকে দিয়েই গেছেন, নেননি কিছু। অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও নীতিমান এ মামা কোনো দিন কারও এক পয়সা নিতেন না, এ রকম মানুষ ছিলেন। গিভ অ্যান্ড টেকে সম্ভবত বিশ্বাসী ছিলেন না। বাবা-মায়ের ভিটার হেফাজত করতেন, পয়সা খরচ করতেন প্রচুর এর রক্ষণাবেক্ষণে। সেই বাড়ি যখন পদ্মায় ভেঙে গেল, মামার আহাজারি দেখে কে! এই জীবনে প্রথম মামাকে কাঁদতে দেখলাম, কিছু কিছু লোক জীবনে এমনই হয়, বুকের ভেতর প্রচণ্ড কষ্ট থাকলেও অন্যকে বুঝতে দেন না বা নিজের দুঃখ অন্যের কাছে প্রকাশ করে না, ভাবে, যদি বিরক্ত হয়। মামা তাদের একজন, বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর মামার মন খারাপ দেখে আমি প্রস্তাব রাখলাম এই বলে যে আমি একখানি ভিটে কিনে দিই, ঘরগুলো আবার দাঁড় করান, যখন পয়সা হয়, আমাকে আবার ফেরত দেবেন। ফেরত দেওয়ার কথা এ জন্যই বললাম যাতে তার আত্মসম্মানে না লাগে। মামা বিনীতভাবে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এই বলে, ‘বাপের ভিটের ঘর আমার সামর্থ্য হলে উঠাব, না পারলে পড়ে থাকবে, তুমি কেন পয়সা দেবে—এটা তোমার দায়িত্ব না, আমার ওপর ছেড়ে দাও।’ মামা ঘরগুলো রেখেই মারা গেলেন—ওগুলো ওভাবেই পড়ে আছে এখনো!
মামা তার সহজ-সরল মনের ভালো লাগার খোরাক মেটাতে রিটায়ার করার পর গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। বিএড পাস করলেন প্রধান শিক্ষক হওয়ার জন্য। তিন বছর পর আবার তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল, প্রচণ্ড জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও মামা শিক্ষকতা ছেড়ে আমাদের ঢাকার বাসায় মায়ের কাছে চলে এলেন পাকাপোক্তভাবে। এবার তাঁর খেয়াল হলো, নামেমাত্র পয়সা নিয়ে গরিবদের হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করবেন। যে কথা সেই কাজ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেকের জন্য এ মহৎ কাজটি করে গেছেন। মামার হার্টের অসুখ ছিল। আমাদের শত অনুরোধের পরও চিকিৎসার জন্য তাঁকে সাধারণ হার্ট বিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়া যায়নি। এতে ভালো-মন্দ যা হয়েছে, কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে তিনি সরে আসেননি। কিছু কিছু লোক সম্ভবত এমনি হয়। মামাকে আমি দোষ দেব কোন সাহসে?

আমার মার লাং ক্যানসার ধরা পড়ায় মাকে আমেরিকা নিয়ে এলেন। আমার মা তিন মাস এখানে ছিলেন। এটা বোধ হয় মামার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন ছিল। মা ভাইয়ের এ কষ্টের কথা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন। নিজের শরীরের কথা না ভেবেই চলে গেলেন। মামা বরাবরই নিয়ম-শৃঙ্খলায় থাকা মানুষ। কারও জন্য বিরক্তের কারণ হতে চাননি। খাওয়াদাওয়া নিজে কিনে আনতেন এবং মজা করে খেতেন, অতিরিক্ত হলে অন্যকে দিয়ে আনন্দ পেতেন। মা দেশে ফেরত যাওয়ার পর মামার শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। হাজার লোক বলেও মামাকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া গেল না। আমেরিকার এক ধূপ লোবানের গন্ধে সুরভিত কাকডাকা ভোরে মায়ের ফোন এল, তোর মামা আর নেই...! দাফন করার লোক পাচ্ছি না, মা ভেঙে পড়লেন। দেলু, নূরু ভাই আরও দু-চারজন মিলে মামাকে জুরাইনের কবরস্থানে দাফন করে এলেন।
রশীদ মামার জীবন ও মৃত্যু বরাবর আমার সামনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি তার উত্তর বের করতে পারিনি। অনেককে আমি জিজ্ঞেস করেছি, তিনি কেন বিয়ে করলেন না, কেউ উত্তর দিতে পারেননি। মাকে জিজ্ঞেস করেছি, মা-ও কিছু জানেন না। চাপা স্বভাবের লোক, কাউকে কিছু খুলেও বলেননি। মামাকে অনেক সময় দার্শনিক মনে হয়েছে, একা একা কথা বলতেন। অনেকে বলেছেন, ওনার সঙ্গে জিন-পরি ছিল। সে যা-ই হোক, মামা একজন ভালো মানুষ ছিলেন, যা ইদানীং দুনিয়ায় বিরল। মামা, তুমি যেখানেই থাক না কেন, ভালো থেকো।

নিউইয়র্ক