একজন কাকা

চেহারায় তাঁর রাজ্যের অভিমান। যতটুকু না অন্যদের ওপর, তাঁর চেয়ে অনেকখানিই যেন নিজের ওপর। চার-চারটি ছেলের বাবা তিনি, কিন্তু একটি ছেলেকেও তিনি নিজ আদর্শে বড় করতে পারেননি। তাই বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনার চেয়ে নেশাতেই বেশি আনন্দ পায় তারা।

বার্ধক্যের যে বয়সটা তার শুয়ে-বসে আর ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর কথা, সেই বয়সটাকে জীবিকা সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত রাখেন তিনি। ক্যাম্পাসের এমন এক জায়গাতে তাঁর ছোট্ট দোকানটি যে সাধারণ মানুষদের চোখও পড়ে না সেখানে। যে কয়জন ছাত্র তাঁর দোকান থেকে কেনাকাটা করে, তা শুধু ভালোবাসা আর করুণা থেকেই কেনে।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও কাঁপতে কাঁপতে দোকান খুলছিলেন তিনি। আমি তাঁকে দোকানের ঝাঁপ উঁচু করতে সাহায্য করার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাকা, আপনি কি অসুস্থ?’ তিনি বললেন, ‘না।’ আমি বললাম, ‘তবে কাঁপছেন যে!’ তিনি বললেন, ‘বুড়া হলে যা হয় আর কী।’ আর একদিন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাকা, আপনার অনেক কষ্ট হয়, তাই না?’ এমন প্রশ্ন শুনে তাঁর মুখে দেখা গিয়েছিল এক অদ্ভুত হাসি, সে হাসির অর্থ, কষ্ট হলেই বা কী করার আছে, বাবা?

তাঁর দোকানে সবমিলে পণ্য থাকত শ পাঁচেক টাকার। এই পণ্য বেচে হয়তো ডাল-ভাত খেয়েই বাঁচতেন তিনি। আমার ইচ্ছা হতো বৃদ্ধ সেই চাচাকে বড় ধরনের কোনো সাহায্য করতে। কিন্তু মানুষের অনেক সাধই সাধ্যের নাগালের বাইরে থাকে। তবুও প্রতিদিন চাচার দোকানে ক্রেতা হয়ে যেতাম আমি। শুধু জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কাকা, কলার হালি কত?’ দাম জেনে টাকা দিয়ে সব পচা কলাগুলো প্যাকেটে ভরে নিতাম। যতটুকু খাওয়া যেত খেতাম, আর বাকিটা ফেলে দিতাম। বৃদ্ধ চাচা তাঁর চোখের ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে হয়তো বুঝতেও পারতেন না, ক্রেতার অভাবে তাঁর দোকানের ঝুলিয়ে রাখা অনেক কলাই পেকে নিচে ঝরে পড়ে। আর তাঁর ছেলের বয়সী এক ছেলে সেই পচা কলাগুলো ভালো কলার দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যায়।