নড়াইলের নায়ক

ঈদুল আজহার দিন দুয়েক আগেই নড়াইলে নিজের বাড়ি গিয়েছিলেন ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছিলেন টানা সাত দিন। ‘রান ফর নড়াইল’ পদযাত্রা, নিজের ক্লাবের অনুষ্ঠান, পরিবার বন্ধুদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটিয়েছেন। আর মাশরাফিকে পেয়ে নড়াইলবাসী বরাবরের মতোই আনন্দে আত্মহারা। সারা দিন ভক্তদের ভিড় তাঁর বাড়ির সামনে। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচের কারণে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ঈদের সময়টা কেটেছে চট্টগ্রামে। তাই তো ঈদের দিন দলের অনেক সদস্যই গেলেন চট্টগ্রামে ক্রিকেটার তামিম ইকবালের বাসায়। তামিমের আমন্ত্রণে ঈদের রাতের খাবারটা ওই বাড়িতে খেলেন তাঁরা। নড়াইলে মাশরাফির ঈদ এবং চট্টগ্রামে তামিমের বাসায় সতীর্থদের ঈদ-ভোজ নিয়ে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
‘রান ফর নড়াইল’ পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: কার্ত্তিক দাস
‘রান ফর নড়াইল’ পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: কার্ত্তিক দাস

ঈদুল আজহার ছুটি কাটাতে নড়াইলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের (ওয়ানডে) অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। এক সপ্তাহের (৩১ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর) এই সফরে অধিনায়ক অংশ নিয়েছেন নানা কার্যক্রমে। খেলেছেন ফুটবল, হেঁটেছেন পদযাত্রায়। সকাল-বিকেল সময় দিয়েছেন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভক্তদের। গভীর রাতে আবার বন্ধুদের আড্ডায় মাশরাফি ধরা দিয়েছেন ২০ বছর আগের কৌশিক হয়ে।

যাত্রা শুরু নতুন এক্সপ্রেসের

নড়াইল জেলাকে অন্যতম বাসযোগ্য শহর বানাতে কাজ শুরু করেছে একটি সংগঠন নড়াইল এক্সপ্রেস। মূলত মাশরাফিকে সঙ্গে নিয়েই এই সংগঠন কাজ করতে চায় জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনসহ নানা বিষয় নিয়ে। ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।

এর আগে বিকেলে সংগঠনটি আয়োজন করে ‘রান ফর নড়াইল’ নামে এক পদযাত্রার। এর নেতৃত্ব দেন মাশরাফি। তাঁর সঙ্গে এই পদযাত্রায় অংশ নেয় নড়াইলের হাজার কয়েক মানুষ। নড়াইলের রূপগঞ্জ বাঁধাঘাট এলাকা থেকে শুরু হওয়া এই পদযাত্রা শেষ হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। 

৩ কিলোমিটার পদযাত্রা শেষে মাশরাফি বলেন, ‘পৃথিবীতে কোনো কাজে কারও একার পক্ষে সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই আমি না, আমরা সবাই মিলে কাজ করব নড়াইলকে বাসযোগ্য শহর বানাতে।’

সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা তরিকুল ইসলাম জানালেন, ‘জেলার জন্য মাশরাফি অনেক কিছুই করতে চান। তার জন্য দরকার ছিল একটা প্ল্যাটফর্ম। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে কাজ করব। এখন তিন মাসের কর্মসূচি আমরা হাতে নিচ্ছি। তিন মাস পর নতুন কর্মসূচি জানাব।’

মাশরাফি অংশ নিয়েছেন পদযাত্রায়। রাস্তার পাশে দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে তা দেখছেন পরিবারের সদস্যরা
মাশরাফি অংশ নিয়েছেন পদযাত্রায়। রাস্তার পাশে দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে তা দেখছেন পরিবারের সদস্যরা

ভক্তদের ভিড়ে

গত ৩১ আগস্ট বাড়িতে আসেন মাশরাফি। সেদিন থেকেই তাঁর বাড়ির সামনে ভক্তদের লম্বা লাইন। দিন যায় আর ভিড় বাড়ে। লাইন আর লাইন থাকে না। ঈদের পরে ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলেও দেখা গেল একই দৃশ্য। বাড়ির গেট, সামনের রাস্তা পুরোটাই ভক্তদের দখলে। শুধু জেলার মানুষ না, তাঁকে একনজর দেখতে আশপাশের নানা জায়গা থেকেই মানুষ আসে।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে আসা দুই তরুণ ফেরদৌস ও রায়হানের সঙ্গে কথা হলো মুর্তজা কটেজের (মাশরাফির বাড়ির নাম) সামনে। কলেজপড়ুয়া রায়হান বললেন, ‘নিয়মিত বাংলাদেশের সব খেলা দেখি। দেশের জয় দেখতে খুব ভালো লাগে। তবে এই জয় দেখার অভ্যাস তো ম্যাশই তৈরি করে দিয়েছেন। তাই আমার স্বপ্নের নায়ককে দেখতে ছুটে এসেছি নড়াইল। দেখাও হয়েছে।’

বলিউডের জলসা (অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি) বা মান্নাতের (শাহরুখের বাড়ি) চেয়ে কোনো অংশে ভক্তদের ভিড় কম থাকে না নড়াইলের মুর্তজা কটেজের সামনে। মাশরাফিও নিরাশ করেন না ভক্তদের। সকালে ও বিকেলে দুই বেলা নিয়ম করে দেখা করেছেন ভক্তদের সঙ্গে। ছবি তুলেছেন, দিয়েছেন অটোগ্রাফও। তবে সেলফির চাপে থাকা মাশরাফি বলেন, ‘নড়াইলে যখনই আসি, দেখি সবার হাতে মুঠোফোন। তাঁদের সঙ্গে সেলফি তুলতে তুলতে আমি তো শেষ! সবাই এতে কী আনন্দ পায় আমি জানি না।’

মাশরাফি যখন ফুটবলার। ছবি: প্রথম আলো
মাশরাফি যখন ফুটবলার। ছবি: প্রথম আলো

ক্রিকেটার যখন ফুটবলার

ক্রিকেট বল হাতে ২২ গজে প্রতিপক্ষকে কাবু করা মাশরাফি নড়াইল এসে খেলেছেন ফুটবল। বাড়ির সামনে সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে ফুটবল খেলতে নামেন মাশরাফি। তাঁদের গড়া শুভেচ্ছা ক্লাবের সদস্যরা দুই দলে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলায় অংশ নেন। সিনিয়র ও জুনিয়র নামে দুই দলে ভাগ হয়ে খেলা এই ম্যাচের নেতৃত্বে ছিলেন মাশরাফি ও তাঁর ছোট ভাই মোরসালিন। ১-১ গোলে ড্র হলেও ম্যাচ ছিল বিনোদনে ভরপুর। মাশরাফির পায়ে বল মানেই দর্শকদের চিৎকার।

শুভেচ্ছা ক্লাবের পুনর্মিলনীতে কথা বলেন মাশরাফি
শুভেচ্ছা ক্লাবের পুনর্মিলনীতে কথা বলেন মাশরাফি

কৌশিকের শুভেচ্ছা ক্লাব

কেউ দিলেন ২ টাকা, কেউ ৫ টাকা। হাইস্কুলপড়ুয়া ১৬ বছরের এক কিশোরের কাছে সে ‘ম্যালা টাকা’। যে টাকা দিয়ে তাঁরা মুখে মুখে গড়লেন একটি ক্লাব, নাম দিলেন শুভেচ্ছা ক্লাব। ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া এই ক্লাবের বয়স এখন ২০ বছর।

ক্লাবের জন্য তৈরি হয় একটি কমিটি। দশম শ্রেণির ছাত্র কৌশিক হলেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। সে সময় ক্লাবের হয়ে নানা জায়গায় ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলতে যেতেন কৌশিকরা। প্রায় সব ধরনের ট্রফিও জিততে থাকে। এর মধ্যে আলাদা করে ক্রিকেটে নজর কাড়তে থাকেন কৌশিক। নড়াইল এক্সপ্রেস বিশেষণে কৌশিক ক্রিকেট বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা নামে।

মাশরাফির কাছে শুভেচ্ছা ক্লাব যে বিশেষ একটা অনুভূতির নাম সেটা আবারও বোঝা গেল এবার ঈদের ছুটিতে। কলকাতায় ‘সেরা বাঙালি’ খেতাব পাওয়ায় মাশরাফিকে বিশেষভাবে সম্মানিত করল সেই শুভেচ্ছা ক্লাব। ঈদের পরদিন এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার হাতে বিশেষ ক্রেস্ট তুলে দেন ক্লাবের সদস্যরা। বিশেষ ক্রেস্ট, কারণ এখানে মাশরাফির নামটা লেখা হয়েছে সোনার হরফে।

কথা হলো ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি সুদীপ্ত শাফায়াতের সঙ্গে, ‘আমরা বন্ধুরা মিলে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। অনেকে বলেন দেশের ক্রিকেটে ওর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাই আমরা প্রতীকীভাবে তাঁর নাম ক্রেস্টে সোনার অক্ষরে লিখেছি। আমাদের ক্লাবটি এখনো জেলা ক্রীড়া সংস্থায় নিবন্ধিত না। এবার আমরা ক্লাবটির নিবন্ধন করাব ভাবছি। কৌশিকের সঙ্গেও কথা হয়েছে বিষয়টি নিয়ে।’

 বন্ধুদের আড্ডায় রাত গভীর

যেকোনো সময় মাশরাফি বাড়িতে আসা মানে তাঁর বন্ধুদের ঈদের খুশি। আড্ডাপ্রাণ মাশরাফি এবারও প্রায় প্রতি রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতেছেন। নড়াইলে এলে সাধারণত চিত্রা নদীর পাড়ে বা খোলা মাঠে বসে আড্ডা দেন মাশরাফি। তবে এবার ছেলে অসুস্থ থাকায় সবাইকে ডেকে নেন বাড়িতেই। মামাবাড়ির একটা ঘর দখল করে তাঁদের আড্ডা জমে। প্রতিদিনের সব কাজ শেষে বন্ধুদের জন্য সময় রাখতেন ১১টার পর। মাশরাফির বন্ধু সঞ্জীব বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের কাছে ঈদ বিনোদনের আরেক নাম কৌশিক। প্রতিদিন রাত ১১টার পর চলে আসি আমরা। আড্ডা শেষ হয় গভীর রাতে। ও (মাশরাফি) সবার সঙ্গে মজা করতে ভালোবাসে। কত কত কথা যে উঠে আসে আমাদের আড্ডায়।’

‘কী বিষয়ে আলাপ হয় সে আড্ডায়?’ ‘সেসব কি আর বলা যায়! বন্ধুদের নিয়ে যাঁরা আড্ডা দেন তাঁরা জানেন, সেখানে কোন কোন বিষয়ে কথা হয়।’ বলেই হাসলেন সুদীপ্ত।