যাত্রা! যাত্রা! যাত্রা!

মঞ্চে ওঠার আগে
মঞ্চে ওঠার আগে

‘সেই একানি শিল্পী হিসেবে যাত্রাদলে কাজ শুরু করেছিলাম। এভাবেই তো ২০-২২ বছর পার হলো।’ লাভলী বেগম তখন নিজের সাজসজ্জা করছিলেন। এক হাতে আয়না আরেক হাত দিয়ে মুখে ফাউন্ডেশন বসিয়ে নিচ্ছিলেন। একটু পরেই মঞ্চে উঠবেন যাত্রাদলের এই নায়িকা। অভিনয় করবেন লাইলীর চরিত্রে। বলে রাখা ভালো, যাত্রাদলে একানি মানে শিশুশিল্পী। লাভলী বেগম শিশু বয়স থেকেই অভিনয় করে যাচ্ছেন যাত্রায়।

সাজঘরের সময়
সাজঘরের সময়

গত ২৯ সেপ্টেম্বর, সারাটা দিনই ছিল টিপটিপ বৃষ্টি, কখনো কখনো তা ঝরেছে অঝোর ধারায়। আগেই জানা হয়েছিল শ্রীমঙ্গলের ইছামতী চা-বাগানে চলছে যাত্রাপালা। নিবন্ধিত যাত্রাদল স্বাধীন বাংলা নাট্যগোষ্ঠী এই বাগানের মন্দিরের মঞ্চে যাত্রা করছে প্রতি রাতে। স্বাধীন বাংলা নাট্যগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ জানিয়েছিলেন, দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন থেকে বাংলাদেশে যাত্রাগানের মূল মৌসুম শুরু হয়। ৩০ চৈত্র (১৩ এপ্রিল) গিয়ে শেষ হয় মৌসুম। চা-বাগানগুলোতে পূজার সময় যাত্রা হয়েই থাকে। সেই যাত্রা দেখতেই যাওয়া ইছামতী চা-বাগানে।

শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি

শ্রীমঙ্গল যাওয়ার আগে সাতগাঁও এলাকায় মূল সড়কের ওপরেই লছনা বাজার। এখান থেকে বাঁদিকে সরু রাস্তা ধরে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার গেলে ইছামতী চা-বাগান। রাত ১১টার পর যখন পৌঁছালাম, তখন একটু অবাকই হতে হলো। যাত্রা প্যান্ডেলের বাইরে শতাধিক গাড়ি, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, সিএনজি। আয়োজকেরা জানালেন শ্রীমঙ্গল থেকে অনেকে এসেছেন, আর এ সময়টাতে বেড়াতে আসা মানুষও আসেন যাত্রা দেখতে। কাঁচা রাস্তা, প্যান্ডেলের আশপাশ, সবই কাদাময়। স্থানীয় মানুষেরাও আসছে দলে দলে।

সূচনা সংগীত—এই মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা
সূচনা সংগীত—এই মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা

ইছামতী চা-বাগানের বাগানিদের আয়োজনেই হচ্ছে এই যাত্রানুষ্ঠান। মন্দিরের নাটমণ্ডপই যাত্রামঞ্চ। টিন ছাওয়া পাকা মঞ্চ। তবে আকারে ছোট। প্রচলিত যাত্রামঞ্চের চেয়ে কিছুটা নিচুও। চারদিক দর্শকে ভরা। ভিড়ভাট্টা ঠেলে আমরা ঢুকে যাই যাত্রামঞ্চের পেছনের সাজঘরে।

যাত্রার অনুষঙ্গ নৃত্য
যাত্রার অনুষঙ্গ নৃত্য

সাজঘরে পুরুষ শিল্পীরা বসে আছেন সার ধরে। প্রত্যেকের সামনে সবুজরঙা টিনের একটা বাক্স। এতেই রূপসজ্জার সব উপকরণ থাকে। কেউ সাজছেন রাজা, কেউ গরিব চাষি, কেউবা নায়ক। যাত্রাদলের নিয়ম হলো শিল্পীদের যাঁর যাঁর মেকআপ বক্স ও পালার দরকারি পোশাক আগেই রাখা থাকে, শিল্পীরা এসে নিজেরা নিজেদের সাজ নিয়ে নেন।

মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’
মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’

জায়গা কম, তাই অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পীদের সাজসজ্জা চলছে অন্য স্থানে—জানালেন স্বাধীন বাংলা নাট্যগোষ্ঠীর নাট্য সম্পাদক সোহ্রাব হোসেন। নিয়ে গেলেন সেখানে। আদতে এগুলো চা-শ্রমিকদের থাকার ছোট ছোট বাড়ি। শিল্পীদের থাকার ব্যবস্থাও এখানে। প্রথম বাড়িটিতে ঢুকে অভিনেত্রী রুবিনা বেগমকে দেখা গেল সাজসজ্জা শেষ করতে। বললেন, ‘এ দলে দশ-এগারো বছর হয়ে গেল।’ পাশের ঘরে সাজছেন নায়িকা লাভলী বেগম। পাশে ঘুমিয়ে আছে শিশু ছেলে। লাভলীর স্বামী শাহীনও তৈরি হচ্ছেন, তিনি এ দলের মাস্টার। বাজনার নেতৃত্ব দেবেন।

মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’
মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’

পাশের বাড়িতে প্রস্তুত হচ্ছেন নৃত্যশিল্পীরা। দুজন শিল্পীকে তখন খেতে দেখা গেল। বাকিরা মেকআপ নিয়ে নাচের পোশাক পরে তৈরি। এই ফাঁকে খাবার সময়টা বলা যাক। যাত্রাদলের নিয়ম অনুযায়ী বিকেল আর সন্ধ্যায় সবাই খান। এরপর রাতের খাবার যাত্রাপালায় যাঁর যাঁর অভিনয় বা নাচ শেষে খেয়ে নেন।

মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’
মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’

নৃত্যশিল্পী শিলা চৌধুরী বললেন, ‘যাত্রাপালা যখন থাকে না তখন ঢাকায় গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে নাচি। আর দল যখন বায়না পায় তখন দলের সঙ্গে চলে আসি।’ নাচ শিখেছেন কোথায়? ‘নিজে নিজেই শিখেছি।’ যাত্রাদলের এই নৃত্যশিল্পীরা নাচ শেখার জন্য তেমন কোনো গুরুর দীক্ষা পাননি। শুধু নাচলেই চলে না, গানও গাইতে হয় তাঁদের। অভিনেত্রী-অভিনেতারাও গান গাইতে পারেন।

মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’
মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’

শুরুতেই বলেছি দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিনে যাত্রা মৌসুমের আনুষ্ঠানিক শুরু। এখানেও সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর নবমীর দিনে ছিল তৃতীয় রজনী। এই রজনীর যাত্রাপালা লাইলী মজনু।

মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’
মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’

রাত প্রায় ১২টা। ইছামতীর এই প্যান্ডেলে তখন হাজারো দর্শক। একদিকে নারী দর্শকদের বসার ব্যবস্থা। সবাই পালা শোনার অপেক্ষায়।
যাত্রা শুরু হলো ‘এই মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা...’ দেশের গান দিয়ে। নাচের শিল্পীরা দাঁড়িয়ে মঞ্চের চারপাশে দর্শকদের দিকে ঘুরে ঘুরে গান গাইলেন। যুগের কারণে যাত্রাতেও যোগ হয়েছে সাউন্ডসিস্টেম, কি-বোর্ড—বাদ্যযন্ত্র বলতে ড্রাম আর কঙ্গো। কি–বোর্ডেই বেজে চলল যাত্রার আবহ সংগীত। গানের পরে শুরু হলো শিশুশিল্পী প্রিয়াঙ্কার নাচ। এরপর সেই ‘ঝুমুর ঝুমুর নাচ’। টানা আটটি নাচে বাণিজ্যিক ধারা থাকলেও অশ্লীলতা নেই। দলের আধিকারিকদের ভাষ্যে এখানে দর্শকেরা যাত্রাপালা দেখতে আসেন, দলেও অশ্লীলতা প্রশ্রয় পায় না। এম এ মজিদ বললেন, ‘গ্রামে এখনো যাত্রার আদিরূপটা দেখা যায়। শহরের কাছাকাছি জায়গায় যাত্রার সঙ্গে অহেতুক অশ্লীল নৃত্যের একটা চাহিদা থাকে আয়োজকদের তরফ থেকে।’ জানা গেল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির লাইসেন্সপ্রাপ্ত যাত্রাদলের সংখ্যা ১০১টি। তবে নিবন্ধন টিকে আছে ৬৫টি দলের।

মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’
মঞ্চে চলছে যাত্রা পালা ‘লাইলী মজনু’

নাচের পরে শুরু হবে ‘বই’। যাত্রার মানুষেরা এখনো যাত্রাপালাকে বই বলেন। শুরু হলো লাইলী মজনু। ইছামতীর এই যাত্রামঞ্চের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জায়গার অভাবে ক্যাচার (ওপর থেকে তারে ঝোলানো মাইক্রোফোন) ঝোলানো যায়নি। তাই হাতে মাইক নিয়ে অভিনয় করলেন শিল্পীরা। মুখের অভিব্যক্তি আর সংলাপ প্রক্ষেপণে মুগ্ধ করলেন দর্শকদের।

শিল্পীরা নিজের সাজ নিজেই সাজেন
শিল্পীরা নিজের সাজ নিজেই সাজেন

রাত গভীর হয়, এম এ রশিদের নির্দেশনায় লাইলী মজনুর প্রেমকাহিনি এগোতে থাকে। মাঝে দুই দফা নাচ। শেষ দৃশ্যে ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া’ গান গাইতে গাইতে লাইলী আর কায়েসের (মজনু) মিলন আর সহমরণ দাগ কেটে যায় মনে। মন ছুঁয়ে যায় যাত্রাশিল্পী আবদুস সাত্তার, সেলিম হোসেন, আবদুল মান্নান, আলম (নায়ক), আশরাফ, মহিবুর রহমান, সাধু, লাভলী বেগম (নায়িকা), রুবিনা ও শিলার অভিনয়।

সাজসজ্জা
সাজসজ্জা

পালা শেষ। আবার আমরা সাজঘরে। এই শিল্পীদের কয়েকজন মাসিক বেতন পান। বাকি অভিনয়শিল্পীরা দিন হিসাবে পারিশ্রমিক পান। এই শিল্পীরা প্রাণের টানেই যাত্রা করেন। অর্থের প্রাচুর্য নেই। শিল্পীদের কথা—যাত্রার দর্শক এখনো রয়েছে, শুধু চাই ভালো পরিবেশ। ‘টপার অভিনেতা’ আবদুস সাত্তার বললেন, ‘যাত্রায় “ন্যাকেড” (অশ্লীল নৃত্য) বন্ধ করেন যাত্রাশিল্প বাঁচবে।’

সন্তান ঘুমিয়ে আছে, মা নিচ্ছেন মেকআপ
সন্তান ঘুমিয়ে আছে, মা নিচ্ছেন মেকআপ

ভোর তখন প্রায় সাড়ে চারটা। পালা শেষে ক্লান্ত শিল্পীরা এখন খেতে বসবেন। এরপর ঘুমাতে যাবেন সবাই। ঘুম ভাঙার পর প্রস্তুতি নেবেন পরের রজনীর জন্য। আমরা ধরলাম ফিরতি পথ। চা-বাগানের সবুজ-সতেজ গাছগুলোর পেছনের আকাশে তখন লাল-সোনালি আলো মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। শুরু হচ্ছে নতুন আরেকটি দিন।

প্রিয়াঙ্কা
প্রিয়াঙ্কা

মায়ের জন্য প্রিয়াঙ্কা

‘এখন আপনাদের নাচ দেখাবে শিশুশিল্পী প্রিয়াঙ্কা...।’ ঘোষণা হতেই মঞ্চে উঠল প্রিয়াঙ্কা। সে সেজেছে নাগিনীর সাজে। মাত্র সাত বছর বয়সে যাত্রার মঞ্চে প্রিয়াঙ্কা এসেছে নৃত্য পরিবেশন করতে। এর কারণটা ঘোষক তখন বলছিলেন মাইকে।

প্রিয়াঙ্কা
প্রিয়াঙ্কা

প্রিয়াঙ্কার মা আছিয়া বেগমের রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে ক্যানসার। চিকিৎসা হচ্ছে ঢাকায়। বাবা এই স্বাধীন বাংলা নাট্যগোষ্ঠীর যাত্রাদলে ফুট–ফরমাশ খাটেন। তাই মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে নাচের পোশাক পরতে হয়েছে ছোট্ট প্রিয়াঙ্কাকে। সাপের নাচ নাচল প্রিয়াঙ্কা। ওদিকে ৫, ১০, ২০ টাকার নোট মঞ্চে ছুড়ে দিচ্ছেন দর্শকেরা। একসময় মঞ্চে টাকার ছোটখাটো একটা স্তূপ দেখা গেল। মেয়ের পরিশ্রমের এই টাকা খরচ হবে মা আছিয়া বেগমের ব্লাড ক্যানসার চিকিৎসায়।

শিল্পীরা নিজের সাজ নিজেই সাজেন
শিল্পীরা নিজের সাজ নিজেই সাজেন

প্রিয়াঙ্কাদের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায়। বিজয় নামে পাঁচ বছরের ছোট একটা ভাইও রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত প্রিয়াঙ্কা। এখন থাকে যাত্রাদলের সঙ্গে। অভিনেত্রী লাভলী তাকে নাচ শেখান। দলের ভেতরে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন দলের আধিকারিকেরা।

শিল্পীরা নিজের সাজ নিজেই সাজেন
শিল্পীরা নিজের সাজ নিজেই সাজেন

প্রিয়াঙ্কা বলে, ‘আমি নাচি মায়ের চিকিৎসার জন্য।’  পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ মেয়েটির। তাই তো প্রিয়াঙ্কা বলে, ‘আমি আবার স্কুলে যেয়ে পড়তে চাই।’