শিউলি ফোটার দিন

‘লাগিল জাফরানী রং শিউলি ফুলে...’ কবি নজরুল এভাবেই শিউলির সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। শরৎ আর হেমন্তের ভোর এত মোহময়। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, বাতাসে শীতের মৃদু স্পর্শ। সারা দিন বিশ্রাম শেষে সূর্য উঁকি দেয় পুবের আকাশে। তখনই শিউলিরা ঝরে পড়তে থাকে নিঃশব্দে, কারণ সূর্যের সঙ্গে যে তার চিরজনমের অভিমান।

শিউলি কোমল সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল, সাদার মাঝখানে জাফরান রঙের ফোঁটা, বোঁটাও জাফরানি। ভোরে গাছের নিচটা ভরে যায় ফুলে, আর কোমল গন্ধে ভরে ওঠে চারদিক।

শিউলির ঝরে পড়ার কোনো এক দিনের প্রসন্ন সকালে আমি প্রথম চোখ মেলেছি, দেখেছি আমার মায়ের স্নিগ্ধ মুখ, দেখেছি অপরূপ পৃথিবীকে।

আমাদের শৈশবে জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হতো না। আম্মা দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তেন, হয়তোবা বিশেষ কোনো খাবার রান্না হতো অথবা বিকেলে বাজার থেকে আসার সময় আব্বা জিলাপি নিয়ে আসতেন।

শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে হোস্টেলে থাকা শুরু হলো। নতুন সব বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হলো, জানাশোনা হলো, প্রত্যেকের জন্মদিনটাও সেভাবে মনে থাকত। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য অনেক পড়াশোনার ফাঁকে বন্ধুদের জন্মদিনের আয়োজন করতাম ছোট করে। ক্যানটিনের সমুচা, ঢাকা লিটনের ড্রাই কেক, চানাচুর অথবা রুমে রান্না করা পায়েস বা নুডলস ইত্যাদি নিয়ে আমাদের আসর বসত হোস্টেলের সামনের শিরীষের নিচে। আমরা গোল হয়ে বসতাম। প্রথমে যার জন্মদিন, তাকে শুভকামনা জানিয়ে কেউবা গান শোনাত, কেউ আবৃত্তি, কেউ চুটকি অথবা কেউ কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণার সঙ্গে সামান্য খাওয়া। আকাশে সন্ধ্যাতারা ফুটে উঠলে আমরা যে যার রুমে চলে যেতাম।

আমি কবিতা লিখতাম, আবৃত্তি করতাম, হাতে পয়সা পেলে কবিতার বই কিনতাম, বন্ধুরা জানত। আমাদের সময় নার্সিং হোস্টেলের সামনে শিউলি ফুলের একটা গাছ ছিল। তো আমার জন্মদিনের ভোরে ঘুম ভেঙে দেখতাম আমার টেবিলের ওপর একটা কবিতার বই আর একটা প্লেটে একগোছা শিউলি ফুল। যত দিন হোস্টেলে ছিলাম, এভাবেই শুরু হয়েছে আমার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। বন্ধুদের দেওয়া বইগুলো আমার সব বইয়ের সঙ্গে সযত্নে তুলে রেখেছি আলমারিতে। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, প্রেমাংশুর রক্ত চাই, রাজা যায় রাজা আসে, অসম্ভবের পায়ে, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা এমন কত বই। বইগুলো ম্লান হয়েছে, স্মৃতি ম্লান হয়নি।

আজ জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। সেদিনের প্রিয় বন্ধুরা অনেকেই দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে, দেখাও হয় না অনেকের সঙ্গে অনেক দিন।

তারপরও প্রতি জন্মদিনের ভোরে ঘুম ভেঙে মনে হয় আমি হোস্টেলের রুমে, আমার সামনের টেবিলে একটা কবিতার বই, শিউলি ফুল তার সুবাস ছড়াচ্ছে, ক্ষণিকের পরে থাকে বুক ভরে চিরজনমের বেদনা এবং আনন্দ। বন্ধুদের সঙ্গে সেই হিরণ্ময় দিনের স্মৃতিতে স্মৃতিময় হয়ে থাকে মন। বারবার মনে হয় জীবনে বন্ধুদের এত ভালোবাসা পেয়েছি—সার্থক জনম আমার।