গাইবান্ধায় যাই আবৃত্তির ক্লাস নিতে। বাহন হিসেবে আলহামরা পরিবহনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। গত ১১ সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটার বাসে ফিরছি। বৃষ্টি পড়ছে। যাত্রীদের দাবিতে বাসের জানালা বন্ধ। বাস নবীনগরে বাঁক নেওয়ার কিছুক্ষণ পর একজন যাত্রীকে নামিয়ে কন্ডাক্টর দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে কাদের সঙ্গে যেন কী বলে বাসে তুলে নিল। কানে এল—এখানেই বসো। ভাবলাম, অবৈধ উপার্জনের ধান্দা বোধ হয়। বাস চলতে শুরু করলে ড্রাইভারের প্রশ্নে সচকিত হলাম—তোমরা যে এভাবে বাসে উঠলে, তোমাদের যদি বিক্রি করে দিই এখন? কিশোরী কণ্ঠের কলধ্বনি শোনা গেল—আমরা জানি, আপনারা সেই রকম না; সে জন্যই উঠেছি। ড্রাইভার-কন্ডাক্টরসহ প্রথম সারির যাত্রীরা সমস্বরে হেসে উঠলেন। ড্রাইভার আবারও বললেন, ‘সব সময় এভাবে উঠবে না, বিক্রি করে দেবে।’ ‘উঠব। হি হি হি...’ কিশোরীসুলভ চপলতায় কলকণ্ঠ ওরা।
কৌতূহল জাগল মনে। গলা লম্বা করে প্রথমে ড্রাইভারকে লক্ষ করলাম। হাসিখুশি তরুণ। গায়ের কমলা-কালো টি-শার্টটা এত সুন্দর ফিটিং হয়েছে যে মডেল মনে হচ্ছে। তারপর মনোযোগী হলাম কিশোরী কণ্ঠের দিকে। বনেটে তিনটি মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে। ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে বোধ হয়। ইউনিফর্ম কালচে-নীল কামিজের সঙ্গে সাদা ওড়না-সালোয়ার। ওরা যে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে নেমে গেল, কন্ডাক্টরের গলা শুনে বুঝলাম—‘না-না-না লাগবে না, যাও। ঝালমুড়ি খেয়ো।’
বাসে চড়েই টের পেয়েছিলাম, এই যাত্রার কন্ডাক্টর একটু অন্য রকম। স্যার-ম্যাডাম ছাড়া কথাই বলছে না। ফরসা, ছিপছিপে গড়নের তরুণ। ভদ্র, বিনয়ী উচ্চারণ। এসি বাস নয়, তারপরও একটু পরপরই এয়ারফ্রেশনার স্প্রে করছে। সিট পেয়েছিলাম ‘এইচ-ওয়ান’। পেছনে বাতাসের অভাবে মাথা ধরে ছিল। এক যাত্রী বাইপাইলে নেমে যাওয়ায় কন্ডাক্টরকে বলে ‘বি-টু’তে এসেছি।
আবার ওদের দেখলে চিনব কি না জানি না, কিন্তু কী ভালো লাগল যে আমার, তা কেমন করে বলি?
মনে পড়ল, জাফরাবাদ থেকে ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে আমিও হেঁটে যেতাম-ফিরতাম। সে সময় দুই দিন পৃথক দুজন রিকশাওয়ালা ‘ওই স্কুলেই তো যাইতেছি, উডো ভাড়া লাগব না’ বলে উপর্যুপরি অনুরোধ করে রিকশায় তুলে নিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে স্কুলে নামিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একদিন ছিল বৃষ্টির দিন।