মুক্তিযুদ্ধের বই পড়ান তাঁরা

বইপাঠ উৎসবে মুক্তিযুদ্ধের বই হাতে শিক্ষার্থীরা। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর, ২০১৬। ছবি: আনিস মাহমুদ
বইপাঠ উৎসবে মুক্তিযুদ্ধের বই হাতে শিক্ষার্থীরা। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর, ২০১৬। ছবি: আনিস মাহমুদ
‘ইনোভেটর’—নামেই আছে নতুন কিছুর ইঙ্গিত। কাজেও তা-ই। নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌঁছানোর জন্য শুরু হয়েছিল সিলেটের এই সংগঠনের যাত্রা। প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বইপাঠ উৎসবের আয়োজন করে পায় পরিচিতি। সংগঠনের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন। আয়োজন করেন বইপড়া প্রতিযোগিতার। মুক্তিযুদ্ধের কথা নতুন প্রজন্মকে জানাতে আরও নানা আয়োজন করেন তাঁরা। ব্যতিক্রমী এই সংগঠন নিয়ে ছুটির দিনের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।

বিকেল হতেই সবাই চলে এলেন সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে। অগ্রহায়ণের তেজহীন রোদ গায়ে মেখে আমাদের কথা শুরু হলো। তাঁদের কেউ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, কেউবা সদ্য স্নাতক। তবে এই আড্ডায় সবার একটিই পরিচয়—ইনোভেটরের সদস্য। একটিই ব্রত তাঁদের, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো।

সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে ইনোভেটরের সদস্যরা। ছবি: ছুটির দিনে
সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে ইনোভেটরের সদস্যরা। ছবি: ছুটির দিনে

‘শুধু জানানো নয়, আমরা নিজেরাও তো জানছি। উৎসবের কাজ করতে গিয়ে বই পড়তে হচ্ছে অনেক। এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা।’ কথা কেড়ে নিয়েই বলতে শুরু করেছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌসী। তিনি ইনোভেটরের সমন্বয়ক। অথচ বছর দুই আগেও ছিলেন অংশগ্রহণকারী। ২০১৫ সালে পেয়েছেন ‘সেরা পাঠক’ পুরস্কার।

ইনোভেটর—মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা সিলেটের সংগঠন। এ সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধের বই। পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে আয়োজন করেন উৎসবের। সে উৎসবে থাকে প্রতিযোগিতা, পুরস্কার—নানা কিছু। ২৮ নভেম্বর সে আড্ডায় জানা গেল আরও অনেক গল্প।

শুরুর কথা

২০০৬ সাল। যেন এক অন্ধকার সময় তখন। চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সক্রিয়। কেউ কেউ মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশ। পাঠ্যপুস্তক থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে আমরা যারা কাজ করতাম—অনেকের মতো আমরাও বিচলিত ছিলাম। রাষ্ট্রের ক্রমাগত এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম।’ বললেন ইনোভেটরের নির্বাহী সঞ্চালক প্রণবকান্তি দেব।

বইপড়া উৎসবে লেখক সেলিনা হোসেনের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
বইপড়া উৎসবে লেখক সেলিনা হোসেনের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

প্রণবকান্তি তাঁর ভাবনা শুনিয়েছিলেন আরেক তরুণ রেজওয়ান আহমদকে। দুজনের ভাবনা ডালপালা মেলে যাত্রা শুরু হয় ইনোভেটরের। তাঁদের সঙ্গে তত দিনে যুক্ত হয়েছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। ‘এসো পাঠ করি, বিকৃতির তমসা থেকে আবিষ্কার করি স্বাধীনতার ইতিহাস’ মূলমন্ত্র নিয়ে এই তরুণেরা গেলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। যোদ্ধাদের কাছে শুনলেন মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা। করলেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র উৎসব, শিক্ষার্থীদের নিয়ে বধ্যভূমি পরিদর্শনসহ নানা আয়োজন।

এসব আয়োজনের মধ্যে তাঁরা বই তুলে দিলেন শিক্ষার্থীদের হাতে। আয়োজন করলেন উৎসবের। নিবন্ধন করলেন মাত্র ৬০ জন শিক্ষার্থী। সংখ্যাটা কম হলেও আশাবাদী ছিলেন আয়োজকেরা। তাই বছর বছর বাড়তে থাকল শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এখন সেটা হাজারের কোঠা পেরিয়েছে।

বইপাঠের উৎসবে, ২০১৬
বইপাঠের উৎসবে, ২০১৬

২০১৬ সাল থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ইনোভেটরের মুখ্য সঞ্চালক রেজওয়ান আহমদ বললেন, ‘এ উৎসবের একটা বিশেষত্ব হলো, টানা এক দশক ধরে কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই প্রতিবছর বইপড়া উৎসব ঘটা করে পালিত হয়ে আসছে। যে লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা শুরু, তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’

সবকিছু ছাপিয়ে বই পড়ানোই এখন রীতিমতো এক উৎসবে রূপ নিয়েছে। এখন পর্যন্ত সংগঠনটি প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থীকে বই পড়িয়েছে। এ ছাড়া চলতি ডিসেম্বরে আরও এক হাজার শিক্ষার্থীকে বই পড়ানোর সব প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছে ইনোভেটর। সংগঠনের দুই কান্ডারি রেজওয়ান আহমদ এখন সিলেট সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আর প্রণবকান্তি দেব সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সহকারী শিক্ষক।

প্রথম বই একাত্তরের দিনগুলি

বই নির্বাচন নিয়েও কম ভাবেন না আয়োজকেরা। বইয়ের মান, মূল্য—সবকিছু বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয় প্রতিবছরের বই। এবার যেমন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে রশীদ হায়দারের শোভনের স্বাধীনতা আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পড়বেন রাবেয়া খাতুনের মেঘের পরে মেঘ

রেজওয়ান আহমদ
রেজওয়ান আহমদ

তাঁদের প্রথম আসর শুরু হয়েছিল শহীদজননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি বই দিয়ে। এরপর শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন, মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়ার জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা, মাহমুদুল হকের খেলাঘর, শওকত ওসমানের দুই সৈনিক, আনোয়ার পাশার রাইফেল, রোটি, আওরাত, শাহীন আখতারের তালাশ, সেলিনা হোসেনের গল্পটা শেষ হয় না এবং সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান-এর মতো বিখ্যাত সব বই।

নির্বাচিত বই বিতরণ ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বইয়ের লেখক ও গুণীজনদের হাজির করার চেষ্টা চলে। এ তালিকায় আছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, লেখক সেলিনা হোসেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, লেখক আবদুশ শাকুর, মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়া, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন, চিত্রনায়ক ফারুক, এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহীমসহ অনেকে।

ঢাকায় ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড–২০১৭’ নিচ্ছেন ইনোভেটরের দুই সদস্য
ঢাকায় ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড–২০১৭’ নিচ্ছেন ইনোভেটরের দুই সদস্য

২০০৭ ও ২০১৬ সালে ইনোভেটরের আমন্ত্রণে বইপড়া উৎসবে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। গত বছরের উৎসবের স্মৃতিচারণা করে তিনি ‘যে জীবন সকলের’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘তারিখটা ছিল ২০ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। শিশুদের কলরোলে মুখর হয়ে ওঠে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। স্কুল শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস গল্পটা শেষ হয় না। আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান। সেদিন এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য ছিল আমার সামনে। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল শিক্ষার্থীরা। শুধু বই নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন! একটি বই হাতে নিয়ে সে কী আনন্দ-উচ্ছ্বাস! একুশের চেতনার শহীদ মিনারে বইপড়ার আনন্দ আমার চেনা পৃথিবী বদলে দেয়। বুঝে যাই, প্রজন্মকে পথ দেখালে ওরা সঠিক পথেই থাকে। আমরাই পারি না ওদের পাশে ঠিকমতো দাঁড়াতে। পারলে দেশ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হবে। মানবিক দীক্ষায় পূর্ণ বাংলাদেশ হবে। ইনোভেটর যে কাজটি করেছে, এমন কাজে সারা দেশে গড়ে উঠুক মনুষ্যত্বের সাধনা।’

স্বীকৃতি ও স্বপ্ন

তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বই পাঠ করানোর স্বীকৃতিও পেয়েছে সংগঠনটি। ২০১৭ সালে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়েছে ইনোভেটরকে। প্রণবকান্তি দেব বললেন, ‘এ পুরস্কার আমাদের দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে বইপড়া উৎসবটি কেবল সিলেট শহরে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে চাই।’

উৎসবটা বইপড়ার

প্রণবকান্তি দেব
প্রণবকান্তি দেব

এই তরুণদের অনেকেই এবার প্রথমবার কাজ করছেন ইনোভেটরের হয়ে। তাই গোড়াপত্তনের গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তাঁরা। গোড়া থেকেই বইপড়ার কাজটিকেই এগিয়ে রেখেছে ইনোভেটর। তাঁদের একজন বললেন, ‘আমাদের পুরো আয়োজনটা প্রায় ছয় মাসের। খোলাসা করে বললে, অক্টোবর মাসে শুরু হয় নিবন্ধনের প্রক্রিয়া। বইপাঠে আগ্রহীরা নভেম্বর মাস পর্যন্ত নিবন্ধন করার সুযোগ পায়। ডিসেম্বর মাসে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উৎসবের মাধ্যমে নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বই। এ বইপড়া শেষে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করা হয় বইপড়া উৎসবের। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মার্চে আরেকটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ী শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়। এই টাকায় তারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নির্বাচিত বইসহ অন্যান্য সুবিধা পায়।’

বইপড়া উৎসব

l চলছে ১১ বছর ধরে
l সিলেট বিভাগের ১৫০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
l ৮ হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ

পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা
পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা