ছদ্মবেশ

‘ভাই আছেন?’ আমি লক্ষ করলাম, ইনবক্সে একটি মেসেজ এসেছে। মেসেজদাতা আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই।

ভদ্রলোক লিখেছেন, ‘ভাই একটা কথা বলতে চাই। কিছু মনে করবেন না। আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব আয়োজন করা হয়েছে। আড়াই পেজের নোট লিখে ফেলেছি। সেই নোট আবার ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করেছি, যাতে সবাই বোঝে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে আমি আপনাকে জানাতে চাই কেন? আপনি সেটা নিয়ে গল্প লিখবেন। আমাকে সেই গল্পের নায়ক বানাবেন।’

তাঁর কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে যেসব গল্প লিখি, সব গল্পেই নায়ক মারা যায়। আমার গল্পের নায়ক বাংলা সিনামার ‘নায়িকার বাবা’ টাইপের। যত যাই হোক, তিনি মারা যাবেনই। এটি চিরন্তন সত্য। এ ব্যাপারে কোনো নড়চড় হবে না।

ইনবক্সে এ-জাতীয় মেসেজ মাঝেমধ্যে আসে। যাঁরা মেসেজগুলো করেন, তাঁরা বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন কোনো কারণে। আমাকে তাঁরা বড় আশা নিয়ে মেসেজগুলো করেন। তাঁদের ধারণা, আমি এমন কোনো কথা শোনাতে পারব, যা শুনে তাঁর আবার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে। তবে তাঁরা দুই মিনিট কথা বলেই নিরাশ হন এবং চট করে বুঝে ফেলেন আমি নির্ভরযোগ্য কেউ নই।

ভদ্রলোককে আমি বললাম, আপনার কঠিন সিদ্ধান্তের কারণ আমাকে বলতে পারেন। তবে গল্প লিখতে পারব কি না, জানি না।

তিনি বললেন, ভাই আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। সে এখন অন্য ছেলেকে বিয়ে করবে, সেই ছেলে আমেরিকায় থাকে। ছেলের বাবার বাড়ি আছে গুলশানে। ছেলের উচ্চতা ছয় ফুট, গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল।

‘ছেলের মোচ আছে?’

‘জানি না ভাই।’

‘বিকাশে অ্যাকাউন্ট আছে?’

‘জানি না।’

‘জানার চেষ্টা করবেন। যে ছেলের বিষয়ে কিছুই জানেন না, তাঁর জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না।’

‘মেয়ের চিঠিগুলো আমার কাছে এখনো আছে। আমি চাইলে এগুলো ফাঁস করে দিয়ে ওর রিলেশন ভেঙে দিতে পারি।’

‘রিলেশন ভেঙে দিলে তো সে আর আপনার কাছে ফিরে আসবে না। তার চেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তেই অটল থাকুন।’

ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ভাই, আপনি কি মজা করছেন আমার সঙ্গে?’

‘জি না। আপনি এক কাজ করতে পারেন। আপনার নোটের একটা কপি আমাকে পাঠাতে পারেন। আমি বানান কারেকশন করে দেব।’

‘কী বলেন এই সব! আপনাকে তো আমার ফালতু লোক মনে হচ্ছে।’

‘জি, ঠিক ধরেছেন।’

‘ধ্যাত! আপনি উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মুডটাই নষ্ট করে দিলেন।’

ভদ্রলোক এরপর চলে গেলেন, আর আমাকে জীবনেও নক করলেন না। আমি শিওর ভদ্রলোক তাঁর কঠিন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি। কোনো মানুষের কষ্টের মধ্যে বিরক্তি ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে সে রেগে যায়। তখন রাগটাই তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে, কষ্টটা গৌণ হয়ে যায়। এই ভদ্রলোকের মাথায় রাগ ঢুকে গেছে। আগামী এক সপ্তাহ আর কঠিন সিদ্ধান্তের কথা ভাবতে পারবেন না।

আমার পরিচিত এক চিত্রকর ছিলেন। তিনি একবার চোখ মুছতে মুছতে আমাকে বলেছিলেন, ‘বুঝলে, ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেউ আমার গুরুত্ব বুঝল না। এই দুনিয়াকে একটা জবাব দেব।’

কিছুদিন পর ভদ্রলোককে দেখলাম এক ছাপরা হোটেলে বসে লবণ দিয়ে ছোট ছোট শিঙাড়া খাচ্ছেন। শিঙাড়ার ভেতরে বাদাম কেন দেওয়া হয়, তা নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনা করছেন শিঙাড়ার কারিগরের সঙ্গে। আমি তাঁকে গিয়ে বললাম, ‘আপনার ভয়ংকর সিদ্ধান্তের কী হলো?’

তিনি তাজ্জব হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চাহনি দেখে মনে হলো তিনি বুঝতে পারছেন না আমার কথা।

আমি চিত্রকর ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসলাম। িশঙারায় বাদাম দেওয়া একটি গর্হিত অপরাধ—এই শীর্ষক আলোচনায় যোগ দিলাম। হঠাৎ মনে হলো, জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো আমরা সাময়িক আবেগের বশে নিয়ে থাকি। সেই আবেগ চলে যাওয়ার পর আমরা কঠিন সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হই, কিছুটা লজ্জাও পাই এবং দ্রুত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি সিদ্ধান্তটি।

জন রাসেল

ঢাকা