পৃথিবীকে দই চিনিয়েছে যে দেশ!

দই দেখলেই জিবে জল আসে। ছবি: সংগৃহীত
দই দেখলেই জিবে জল আসে। ছবি: সংগৃহীত

বাঙালির পরিচয় তার মিষ্টান্নের পসরায়। আর দই? দাওয়াত বাড়িতে যতই কবজি ডুবিয়ে খান না কেন, শেষ পাতে এই দই না পেলে কিন্তু খাওয়াটা ঠিক জমে না। বাঙালি যেমন দই খেতে পছন্দ করে তেমনি খাওয়াতেও। বিয়েবাড়িতে হয়তো গলা পর্যন্ত খেয়ে কাহিল, তবুও দেখবেন পাশ থেকে কে যেন পাতে তুলে দিল আরও এক খাবলা দই! এটাই বাঙালির আতিথেয়তার আবহমানকালের রীতি। আর এই রীতির প্রভাবেই আমরা ভেবে নিই দইয়ের উৎপত্তি হয়তো এ মাটিতেই। ভুল!

দইয়ের পরিচিতি পৃথিবীজুড়ে। দুগ্ধজাত এই খাবারটির বয়স চার হাজার বছর। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, প্রথম কোন দেশে দইয়ের উৎপত্তি? দুধ ও ব্যাকটেরিয়ার যুগলবন্দীতে সৃষ্ট এ খাবারটির সঙ্গে পৃথিবীর পরিচয় ঘটেছে কোন দেশের বদৌলতে? জবাবে ঐতিহ্যগত কারণেই আমাদের ভাবনা হয়তো উপমহাদেশের বাইরে যাওয়ার কথা নয়। দুঃখিত, এবারও ভুল!

বুলগেরিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ট্যারাটর’—যা দই দিয়ে বানানো। ছবি: বিবিসি
বুলগেরিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ট্যারাটর’—যা দই দিয়ে বানানো। ছবি: বিবিসি

স্কুলে থাকতে ড. মুহম্মদ এনামুল হকের ‘গ্যাব্রোভোবাসীর রস-রসিকতা’ প্রবন্ধটি নিশ্চয়ই পড়েছেন? না পড়লে ক্ষতি নেই। ফুটবলপ্রেমী হলে নিশ্চয়ই রিস্টো স্টয়চকভের নাম শুনেছেন? সেই রসাত্মক প্রবন্ধটি যে দেশের মানুষদের কৃপণতা নিয়ে লেখা, স্টয়চকভের জন্ম সেই দেশে—বুলগেরিয়া—যেখানে দই ছাড়া মানুষের একমুহূর্ত চলে না!
দইয়ের বীজাণুর নামটা জানেন? ‘ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ’। নামেই তো দেশটির সংস্পর্শ টের পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বুলগেরিয়ার প্রায় সব খাবারেই আপনি দইয়ের স্বাদ পাবেন। সেটা শুধু এক পদের দই নয়, নানা পদের নানা স্বাদের দই। যেমন ধরুন, বুলগেরিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ট্যারাটর’ নামের ঠান্ডা স্যুপ, যার মূল উপাদান কিন্তু দই। রাজধানী সোফিয়ার বাসিন্দা নিকোলা স্টইকোভ বিবিসি ট্রাভেলকে বলেন, ‘আমরা সবকিছুতে দই ব্যবহার করি। নিজে যেমন প্রতিদিন তিন পাত্র দই খাই। সকালে নাশতায়, দিনে স্ন্যাকসের সঙ্গে আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে।’
তা এই বুলগেরিয়ায় দই এল কীভাবে? এখানকার বহু মানুষের দাবি, প্রায় চার হাজার বছর আগে যাযাবর জাতি ‘নোমাডিক’দের হাত ধরে এ দেশে দইয়ের উৎপত্তি। সেটা অবশ্য দুর্ঘটনাক্রমে—‘নোমাডিক’রা দুধ বহন করত প্রাণীর চামড়া দিয়ে বানানো থলেতে। যা ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টির আদর্শ পরিবেশ এবং সেই ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে গাঁজন প্রক্রিয়ায় থলেতে রাখা দুধ দই হয়ে যেত।

বুলগেরিয়ান কৌটাজাত দই। ছবি: বিবিসি
বুলগেরিয়ান কৌটাজাত দই। ছবি: বিবিসি

ঐতিহাসিকদের মতে, সমসাময়িককালে একইভাবে হয়তো আরও কিছু অঞ্চলে দইয়ের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রথম দই বানানোর দাবিদার দেশটি নিশ্চিতভাবেই মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া আর বুলগেরিয়ার বাইরে নয়। সে যে অঞ্চলই হোক না কেন, বুলগেরিয়া যে বাণিজ্যিকভাবে পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রথম দই খাইয়েছে, তা নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীকে দই চেনানো দেশটিও তো বুলগেরিয়া!
দইয়ের গুপ্ত রহস্য ভেদ করা প্রথম বিজ্ঞানীটি বুলগেরিয়ার। ড. স্টামেন গ্রিগোরভ। ১৯০৪ সালে বিয়ের কিছুদিন পর জেনেভার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন গ্রিগোরভ। তখন তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সঙ্গে ছিল ‘রুকাটকা’ নামের মাটির পাত্রে বানানো দই। পরীক্ষাগারে সেই দই নিয়ে এক বছর ঘাম ঝরানোর পর গ্রিগোরভ আবিষ্কার করেন, গাঁজন প্রক্রিয়ায় দুধ থেকে দই হতে ঠিক কোন ব্যাকটেরিয়া দায়ী।
গ্রিগোরভ এবং বুলগেরিয়ানদের দইপ্রীতির সম্মানে সেই বীজাণুটির নাম রাখা হয়—‘ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ’। এতে দইয়ের সঙ্গে বুলগেরিয়ার সম্পৃক্তি টেকসই ভিত্তি পেয়ে যায় চিরকালের মতো! শুধু তা-ই নয়, গ্রিগোরভের এই আবিষ্কারকে সম্মান করে তাঁর জন্মভূমি বুলগেরিয়ার ত্রার্নে একটা জাদুঘরও বানানো হয়—এটা দই নিয়ে পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর!

বুলগেরিয়ার ত্রার্নে দই নিয়ে পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর। ছবি: বুলগেরিয়াট্রাভেল
বুলগেরিয়ার ত্রার্নে দই নিয়ে পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর। ছবি: বুলগেরিয়াট্রাভেল