গ্রন্থাগারের বয়স ১২৭ বছর

প্রতিদিন এমন অনেক পাঠক বই পড়তে গ্রন্থাগারে আসেন  ছবি: হাসান মাহমুদ
প্রতিদিন এমন অনেক পাঠক বই পড়তে গ্রন্থাগারে আসেন ছবি: হাসান মাহমুদ

তালপাতায় হাতে লেখা দুর্লভ কিছু পাণ্ডুলিপি। ১২১ বছরের পুরোনো বাংলা পত্রিকা। দেশ-বিদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, কবিতা, গল্প, বিজ্ঞান, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা-বিষয়ক বই। আছে পুরোনো স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা। ১২৭ বছর ধরে এমন প্রায় ৩২ হাজার বইয়ের ভান্ডার নিয়ে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে পাবনার অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি।

দুর্লভ বইয়ের সঙ্গে পাঠকদের পরিচিত করতে পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে আয়োজন করা হয়েছে বইমেলা। শহরের মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল পৌর মুক্তমঞ্চ প্রাঙ্গণে এক মাসব্যাপী চলবে এই মেলা। এ ছাড়া লাইব্রেরি মিলনায়তনে চলছে সপ্তাহব্যাপী পুস্তক প্রদর্শনী।

৩১ জানুয়ারি বিকেল চারটা। তখনো পুস্তক প্রদর্শনীর প্রস্তুতি চলছিল। সাদা কাপড়ে মোড়ানো টেবিলগুলো সাজানো হচ্ছিল নতুন-পুরোনো বইয়ে। পাঠাগারের কর্মীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন বই গোছাতে। মেলার আনুষ্ঠানিকতা এক দিন পর শুরু হলেও বইপ্রেমীরা হাজির হয়েছিলেন সেদিনই।

পাবনার পাঠকদের এমন বইপ্রীতিই পাঠাগারটিকে এগিয়ে নিচ্ছে। জানা গেল, সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে পাঠাগারটি পরিচালিত হয়। এ জন্য ১৭ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। পরিষদে সভাপতির দায়িত্বে আছেন স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী, মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন সাংবাদিক আবদুল মতীন খান।

গোড়াপত্তনের কথা

অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির শুরুটা ১৮৯০ সালে। তখন জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার ছিলেন গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরী। তাঁর ছেলে বরদা গোবিন্দ চৌধুরীর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি একটি ছেলে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই ছেলে অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরীর নামেই এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা। শুরুতে ১৩ শতাংশ জমির ওপর দুই কক্ষের একটি ভবন নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন পাবনা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর এফ বিজ। তখনো পাবনায় বিদ্যুৎ আসেনি। পাঠকের সুবিধার জন্য লাগানো হয়েছিল ১৩ টাকা আট আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইট। সন্ধ্যার পর সে আলোয় পড়াশোনা করতেন পাঠকেরা। ১৯৩৬ সালে ১০০ টাকা ব্যয়ে পাঠাগারটিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেওয়া হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠাগারটি খোলা থাকে পাঠকের জন্য।

১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে পাঠাগারটির ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে আসেন সাহিত্যিক পরিমল কুমার গোস্বামী এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সময়ের পরিক্রমায় পাঠাগারটির পুরোনো ভবন ব্যবহার অনুপযোগী ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে।  তখন পাঠাগারটির উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন দেশবরেণ্য শিল্পপতি ও স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী। তাঁর সহযোগিতায় ছয়তলা নতুন লাইব্রেরি ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।

বর্তমানে ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় মূল পাঠাগার, রয়েছে বিশাল তিনটি পাঠকক্ষ। এখানে সব শ্রেণি, বয়স এবং পেশার পাঠকদের সুবিধার্থে বই, ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকা পৃথকভাবে বিন্যাস করা রয়েছে। মোট চারটি বিভাগে ১৭০টি আসন রয়েছে পাঠকের জন্য। পাশাপাশি একটি মিলনায়তনসহ আছে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।

গ্রন্থাগারের সভাপতি অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘গ্রন্থাগারটিকে আমরা আরও আধুনিক করতে চাই। বইমেলা, সেমিনার ও নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে গ্রন্থাগারমুখী করার চেষ্টাও আমরা করছি।’

বইভান্ডার

দৈনিক সংবাদপত্র থেকে শুরু করে পাঠাগারটিতে রয়েছে বিশাল বইভান্ডার। সাধারণ জ্ঞান, কম্পিউটার, বিজ্ঞান, বক্তৃতা, অর্থনীতি, আইন, গণিত, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, সাধারণ জ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, হিসাববিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা, চারুকলা, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, অভিধান, বিশ্বকোষ, সাংবাদিকতা, লোকসাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, শিশুসাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় ৩২ হাজার বই আছে এখানে।

এ ছাড়া আছে ৯ হাজার ৮০৬টি হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, ২০ হাজার জার্নাল, তিনটি হাতে লেখা তালপাতার বই ও ৩০০ বছরের পুরোনো ইংরেজি, বাংলা, উর্দু ও ফারসি ভাষার চার শতাধিক বই। আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার বাঁধাই করা সংকলন ও ১৮৮১ সালের প্রভাতি পত্রিকার সংকলন।