আপাদমস্তক স্বেচ্ছাসেবক

নাসিরুল আলম মন্ডল। ছবি: সাজিদ হোসেন
নাসিরুল আলম মন্ডল। ছবি: সাজিদ হোসেন

তাঁর সম্পর্কে জানার পর পুরোনো সেই কথাটি মনে পড়ল। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষ যেন! তবে আক্ষরিক অর্থে তিনি মোষ তাড়ান না, আগ্রহ নিয়ে জড়িয়ে পড়েন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে। কখনো নিজেই ত্রাণসামগ্রী কাঁধে ছুটে যান দুর্গত এলাকায়, কখনো সংগ্রহ করে দেন স্বেচ্ছাসেবক, কোন এলাকায় সহায়তা প্রয়োজন—অনেক সময় জোগাড় করে দেন সে তথ্যটুকু। এভাবেই জড়িয়ে আছেন শ খানেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে! সাহায্য করেন ব্যক্তি উদ্যোগেও। এই স্বেচ্ছাসেবকের নাম নাসিরুল আলম মন্ডল। বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায়। পেশায় শিক্ষক, পড়ান কালীগঞ্জের দলগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ে।

নাসিরুলের সঙ্গে আলাপ হলো ঢাকায়। বান্দরবান গিয়েছিলেন। গত ৩১ জানুয়ারি রাতে যখন এলেন, তাঁর চোখেমুখে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি। বললেন, ‘তিন দিন একরকম গাড়ির ওপরই আছি।’ তাই তো হওয়ার কথা—রংপুর থেকে ঢাকা হয়ে গেছেন বান্দরবান। দিনভর কাজ শেষেই ঢাকার বাসে উঠেছেন। রাতে রংপুরে ফেরার তাড়া নিয়েই বসেছেন প্রথম আলো কার্যালয়ে।

বান্দরবানে কেমন ঘুরলেন? এমন প্রশ্নের জন্য যেন আগেই প্রস্তুত ছিলেন। মুখে শুষ্ক হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘ঠিক ঘুরতে যাইনি। কয়েকজন বন্ধু মিলে পাহাড়ের সুবিধাবঞ্চিত আদিবাসী শিশুদের জন্য একটি স্কুল নির্মাণে সহায়তা করছি। সেটার কাজেই যাওয়া। এ ছাড়া গত বছরের ভয়াবহ পাহাড়ধসের পুনর্বাসন কার্যক্রমের কিছু কাজ ছিল।’

গাছের চারা নিয়ে হাজির
গাছের চারা নিয়ে হাজির

একটু দম নিয়ে আবার নিজেই বলে গেলেন, ‘ঘোরাঘুরির শখ থেকেই পাহাড়ের এই অসহায় মানুষগুলোর কথা জেনেছি, দেখেছি তারা কতটা সুবিধাবঞ্চিত।’

এসব বঞ্চিত মানুষের জন্যই তো তাঁর মন কাঁদে। তাই কখনো নিজে উদ্যোগী হয়ে, কখনো সংগঠনের হয়ে যখনই পেরেছেন, নাসিরুল ছুটে গেছেন পাহাড়ে-হাওরে। এ কারণেই শুধু নিজের এলাকা লালমনিরহাট কিংবা উত্তরবঙ্গেই নয়, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়।

স্বেচ্ছাসেবার নানা কথা ধীরে ধীরে মেলে ধরলেন নাসিরুল। আমরা জানতে পেলাম, তাঁর স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ওঠার শুরু নিজ গ্রামেই। এমনও হয়েছে, গ্রামের কেউ ভীষণ অসুস্থ, হাসপাতালে নিতে হবে—ডাক পড়বে নাসিরুলের। গ্রামের কেউ শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবেন, পরামর্শের জন্য আছেন সেই নাসিরুল। আরও পরে এমন অনেক কিছুর সঙ্গেই যুক্ত হলেন তিনি। বললেন, ‘অনেক মানুষকে আমি চিনিও না। তাঁরা আমাকে ফোন দেন, ঠিকানা নেন, সহায়তাসামগ্রী পাঠিয়ে দেন। না করতে পারি না। তখন খুঁজে বের করতে হয় দুর্গত এলাকা। কখনো নিজেই ত্রাণ নিয়ে যাই, কখনো পরিচিতদের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করি। এভাবেই যুক্ত থাকি সংগঠনগুলোর সঙ্গে।’

বান্দরবানে ত্রাণ বিতরণ
বান্দরবানে ত্রাণ বিতরণ

দলগ্রাম ক্ল্যাসিক ক্লাবে শুরু

২০০৩ সালে নাসিরুল আলম মন্ডল উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। গ্রামের সড়ক মেরামত করতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়লেন দলবলে। গরিব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ দরকার, সংগ্রহের জন্য চলে যান সচ্ছল মানুষের কাছে। শুধু সেবার কাজই নয়, গ্রামে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তাঁরা। এভাবেই চলছিল। বন্ধুরা বললেন নিজেদের একটা সংগঠন দরকার। গড়ে তুললেন ‘দলগ্রাম ক্ল্যাসিক ক্লাব’।

নাসিরুলের এই সংগঠনটি এখনো আছে। এখনো সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামের নানা কাজ করেন। তবে গ্রামের গণ্ডি পার করেছিল আরেকটি সংগঠন। সেটির নাম ‘হামার লালমনি’।

সখ্য বাড়াল হামার লালমনি

নাসিরুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করেন ২০০৮ সাল থেকে। যার যা কাজ! ফেসবুকে একদিন তাঁর নজরে এল ‘হামার লালমনি’ নামে একটি গ্রুপ। যোগাযোগ করেন সংগঠনটির সঙ্গে। কয়েক দিনের মধ্যেই হামার লালমনির নানা কর্মসূচির সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন নাসিরুল। শীতবস্ত্র বিতরণ, একজন সাংবাদিকের জন্য চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহ ও রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় একজনকে পুনর্বাসন—এমন আরও নানা কাজ করলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কয়েক মাস পেরোতেই সংগঠনটির অ্যাডমিন করা হলো তাঁকে। সখ্য বাড়তে থাকলে অনেক মানুষ ও সংগঠনের সঙ্গে। কাজের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকল দেশজুড়ে।

গ্রামে তথ্য সংগ্রহ
গ্রামে তথ্য সংগ্রহ

ব্যাপ্তি বাড়াল ‘আমরা খাঁটি গরিব’

তত দিনে ‘আমরা খাঁটি গরিব’ নামে ফেসবুকভিত্তিক আরেকটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন নাসিরুল। ২০১১ সালে সারা দেশেই নানা ধরনের কাজ করত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের কোনো জেলায় কর্মসূচি হাতে নিলেই যুক্ত হন নাসিরুল। এভাবে কাজ করতে করতেই নাসিরুলকে রংপুর বিভাগের দায়িত্ব দেয় সংগঠনটি। কিন্তু ২০১৪ সালে ঘোষণা দিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ‘আমরা খাঁটি গরিব’। নাসিরুল আলম মন্ডল বললেন, ‘কাজের ব্যাপ্তি তখন আমার বেড়ে গেছে। তাই কোনো একটি সংগঠনে আটকে না থেকে যার যখন দরকার তার হয়েই কাজ করে দিই।’

তারপর তিনি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ, ফোরাম এসডিও, স্বপ্নরথ, উই ফর অল, আলোর মিছিল, স্পৃহা, সবুজ পৃথিবী বাঁচাও, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাব, চলো করি, ট্রমসো বাংলাদেশ কমিউনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন। নাসিরুল বললেন, ‘স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রায় ১০০ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে আমি যুক্ত। রংপুর বিভাগের যেকোনো উদ্যোগে আমি কাজ করি।’

জীবন নামের রেলগাড়ি

তাঁর কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, স্বেচ্ছাসেবা ছাড়া জীবনে আর কিছুই নেই তাঁর। তবে অন্য জীবনের কথা জেনে পরিচয় মিলল ভিন্ন এক নাসিরুলের। যে নাসিরুল পড়াশোনাতেও অগ্রগামী। ২০০০ সালে দলগ্রাম উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি শেষে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানে। ভালোই চলছিল সব। হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল নাসিরুলের জীবন। তিনি বলেন, ‘বাবার স্ট্রোক হওয়ার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে হয়। আমার দুই বোন পড়াশোনা করছিল, তাদের পাশে দাঁড়াতে হলো। বড় বলে সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকে।’

ত্রাণসামগ্রী বিতরণের আগে সাহায্যপ্রার্থী মানুষের সঙ্গে নাসিরুল আলম মন্ডল। ছবি: সংগৃহীত
ত্রাণসামগ্রী বিতরণের আগে সাহায্যপ্রার্থী মানুষের সঙ্গে নাসিরুল আলম মন্ডল। ছবি: সংগৃহীত

তারপরও পড়াশোনা বন্ধ করেননি নাসিরুল। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। নানা ঘাট মাড়িয়ে এখন চাকরি করছেন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পড়িয়েছেন ছোট দুই বোনকে। নাসিরুল বললেন, ‘আমার বোন এমবিবিএস শেষ করে এখন রংপুর আর্মি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক। ছোট বোনটাও স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ে। পরিবারের সমর্থন পেয়েছি বলেই স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পারছি। চাকরি শুরু করার পর প্রতিষ্ঠানপ্রধান, সহকর্মীদের সহায়তা পেয়ে এসেছি বরাবর।’

আমরা কথা বলেছিলাম দলগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে। নাসিরুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর কথায় ধরা দিল গৌরবের সুর, ‘শিক্ষক হিসেবেও তিনি ভালো। নিজে কাজ করেন। অন্য যাঁরা করেন তাঁদের সঙ্গেও যুক্ত থাকেন। এমন একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।’

অনুপ্রেরণা শুধু কি শিক্ষার্থীরা পান? ‘নিজের কোলে ঝোল টানা’ মানুষের ভিড়ে এমন নাসিরুল আলম মন্ডলরাই তো অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন সমাজের, অসহায়দের জন্য কিছু করতে চাওয়া মানুষের।

বন্যার্ত মানুষের হাতে ত্রাণ বিতরণ
বন্যার্ত মানুষের হাতে ত্রাণ বিতরণ