আম্মার মুখ

অলঙ্করণ: আরাফাত করিম
অলঙ্করণ: আরাফাত করিম

২৪ জানুয়ারি ২০১৮। ভোর থেকেই অস্থির লাগছিল। আম্মা ভীষণ অসুস্থ। বারবার খবর নিচ্ছিলাম। কিন্তু রোজকার কাজ তো থেমে থাকে না। প্রতিদিনের পত্রিকার ছবি পর্যালোচনা করলাম, একটা প্রতিযোগিতার বিচারকাজে বসে ছবিও বাছাই করলাম। কিন্তু কিছুতেই মন বসছিল না।

বেলা তখন একটা। রংপুর থেকে ভাইয়ার ফোন। বললেন, ‘বিমানের টিকিট কাটা হয়েছে, তোমার ভাবিসহ তোমরা এখনই রওনা দাও।’ তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে নিলাম। স্ত্রী, দুই বাচ্চা, ভাবিসহ আমরা পাঁচজন যাত্রা শুরু করলাম দ্রুত।

যাত্রাবাড়ী থেকে দোলাইরপাড় হয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার টোলপ্লাজা পেরিয়ে আসতে ১০ মিনিট চলে গেল। চানখাঁরপুল দিয়ে গাড়ি খুব ধীরে এগিয়ে চলছে। এরপর আর চলল না। একদমই থেমে গেল গাড়ির চাকা।

অপেক্ষা করছি। সে অপেক্ষা দীর্ঘ হতে থাকল। ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়ার কোনো নামগন্ধ নেই। অধৈর্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। কিছুটা হেঁটে দায়িত্বরত পুলিশ সার্জেন্টের কাছে গেলাম। তাঁকে সমস্যার কথা বলার আগেই তিনি নানা কথা বলতে শুরু করলেন। একসময় সমস্যার কথা শুনলেন, অনুনয় করলাম। তিনি কথা রাখলেন। সিগন্যাল ছেড়ে দিলেন।

আমিও তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে রাস্তা ফাঁকা করছি। একটি অ্যাম্বুলেন্স পার হয়ে গেল। ভেতর থেকে উৎকণ্ঠিত একজন হাত উঁচিয়ে ধন্যবাদ জানালেন। ততক্ষণে বেলা তিনটা বেজে গেছে। বিমান ছাড়বে বিকেল চারটায়। হাতে সময় একদম নেই। গাড়ি ছুটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হয়ে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সামনে আবার ভয়াবহ যানজট। সবই থেমে আছে। কারও কিচ্ছুটি করার নেই!

পিঁপড়ার গতিতে পৌনে চারটার দিকে ঢাকা সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেটে চলে এলাম। অসহায় হয়ে সেনাসদরের ভেতরে গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেলাম। আটকালেন সেনাসদস্যরা। বললাম, ‘মা অসুস্থ, বিমান ধরতে হবে, প্লিজ যেতে দিন।’

তাঁদের দয়া হলো। আবার গাড়ি চলতে শুরু করল। আমরা চলছি বিমানবন্দরের দিকে। এয়ারওয়েজ থেকে ফোন এল। জানালাম, আমাদের ১৫ মিনিট লাগবে। বললেন, ফ্লাইট একটু বিলম্ব হবে, আমরা যেন দ্রুত যাই।

রংপুরে বারবার যোগাযোগ করছি। উৎকণ্ঠা বাড়ছে। গাড়ি বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে চলছে। বিমানবন্দরে পৌঁছেই রুদ্ধশ্বাসে ভেতরে ছুটতে শুরু করলাম। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ আটকাল। জানাল, তিন মিনিট আগে ফ্লাইট ছেড়ে গেছে। সেদিন সেটাই ছিল শেষ ফ্লাইট।

মনটা বিষাদে ভরে উঠল। উৎকণ্ঠা আর ক্ষোভ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই গাবতলী বাস টার্মিনালের পথ ধরলাম। এসে টিকিট পেলাম রাত ১২টার একটি বাসের।

ভাইয়া প্রতিনিয়ত কথা বলছেন। সর্বশেষ জানালেন, ‘আম্মা আইসিইউতে আছেন, অবস্থা অপরিবর্তিত।’ রাত ১২টায় যাত্রা শুরু হলো। টাঙ্গাইলে দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকতে হলো। সব বাধা পেরিয়ে রংপুরে পৌঁছালাম পরদিন সকাল আটটায়।

বাসস্ট্যান্ড থেকে খুব বেশি দূরে নয় আমাদের বাসা। কিন্তু পথ যেন শেষ হতে চাইছে না। আমাদের গুপ্তপাড়ায় ঢুকতেই লক্ষ করলাম পরিচিত মানুষেরা আমাকে দেখছে! তাদের দৃষ্টিতে মিশে আছে সান্ত্বনার পরশ। ভেতরটা কেঁপে উঠল।

এমন সময় রংপুরের সাংবাদিক মানিক সরকারের ফোন। ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথায়? কত দূর?’ আরও অনেক কথা বললেন। শেষে শুধু বললেন, ‘তুমি আর আমি এখন থেকে একই দলে!’ আমার বুঝতে কষ্ট হলো না মানিকদা আমাকে কোন দলের কথা বলছেন। তাঁর মা যে কদিন আগেই পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন।

বাসায় এসে নামলাম। ঘরের সামনে অনেক মানুষ। কেউ কিছু বলছে না। কিংবা অনেক কিছু বলার চেষ্টা করছে, ঠিক ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শোক সান্ত্বনার কোনো ভাষা হয়? হয় না।

প্রথম জানাজা শেষে আম্মাকে নিয়ে পারিবারিক গোরস্থান পাটগ্রামের লতামরির দিকে রওনা দিলাম। আম্মার শেষবিদায় হবে, সব প্রস্তুত। পৃথিবীতে আল্লাহ আমাকে অনেক কিছু দেখিয়েছেন, কিন্তু আমার আম্মার এমন সুন্দর হাসিমুখ জীবনেও কোথাও দেখিনি। আম্মা হাসিমুখে ঘুমিয়ে আছেন, তাঁকে বিরক্ত না করে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রেখে এলাম দাদু-দাদি-চাচাদের পাশে, পারিবারিক গোরস্থানে।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। ঢাকায় ফিরে এসে নেমেছি। আজ কোনো তাড়াহুড়ো নেই। বিমানবন্দর থেকে ৫ ঘণ্টায় যাত্রাবাড়ী যেতে যেতে ভাবছি, কত কিছুই হবে বাংলাদেশে, সুন্দর রাস্তা হবে, ফ্লাইওভার হবে, মেট্রোরেল হবে। সবই এগিয়ে চলবে। আলাদা ভিআইপি লেনও হয়তো হবে, তাঁরা তাঁদের স্বজনদের জীবিত মুখ প্রতিবার দেখার সুযোগ পাবেন। ভালো তো, ভালো না! কিন্তু আমরা...