আমি তাদেরই একজন

সময়টা ২০০৬। বগুড়ায় প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ সিরিজের আয়োজন হয়েছে। প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদা পেয়েছে শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম। খেলা তো দেখতেই হবে!

জেলা পরিষদে টিকিট দেওয়া হবে যেদিন, সেদিন ভোরে আলো ফোটার আগেই চলে যাই টিকিট নিতে। জেলা পরিষদের ফটকের বাইরে ৩৫-৪০ জনের পেছনে সারিতে দাঁড়ালাম। টিকিট বিক্রি শুরু সকাল আটটায়। ভাবলাম খুব দ্রুতই টিকিট পাব। খালি সময়ের অপেক্ষা!

আটটা বাজতে বাজতে আমাদের লাইনটা পেছনের দিকে দৃষ্টিসীমানা পার। শুনলাম, জেলখানা মোড় থেকে লাইন দুই ভাগ হয়ে একটা গেছে বকশীবাজারের দিকে, আরেকটা গেছে মহিলা সমিতির দিকে!

আটটার দিকে হঠাৎ জেলা পরিষদের গেটটা খুলে দিল। ঘোষণা দিল, পরিষদের ভেতরে লাইন ধরতে হবে। মহা বিশৃঙ্খল অবস্থা শুরু হয়ে গেল। এলোপাতাড়িভাবে হাজারো মানুষ গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ল। সকাল থেকে ধরে থাকা লাইন পুরাই শেষ! আমি ছোট মানুষ তখন, টেনে পড়ি। কোনোমতে ভেতরে গিয়ে কয়েকজনের পেছনে দাঁড়াতে পারলাম!

 টিকিট দিচ্ছে দোতলায়। একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে অন্য দিকের সিঁড়ি দিয়ে নামার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোধ হয় ঘণ্টা দুয়েক পর সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতে পারলাম। চার ফুটের মতো প্রশস্ত সিঁড়িতে প্রায় এক শ মানুষ! সিঁড়িতে একটা পা দেওয়ার পর আমার পা আর সিঁড়ি ছোঁয়নি। মানুষের ঠেলাঠেলি আর চাপেই অর্ধেক পর্যন্ত উঠলাম। সেখানে কয়েকজনকে দেখলাম এতটাই হাঁপিয়ে উঠেছে যে আর ওপরে যেতে চাচ্ছে না, হাতে-পায়ে ধরছে ওখান থেকে বের করে দেওয়ার জন্য! আমার অবস্থাও ত্রাহি ত্রাহি। ওপরে তাকিয়ে দেখি দুজন পুলিশ কয়েকজন করে মানুষকে করিডরে তুলে নিচ্ছে, তারপর আবার লাঠি দিয়ে বাকিদের ব্যারিকেড দিয়ে রাখছে। এভাবে কিছুক্ষণ পরপর ৮ থেকে ১০ জন করে ওপরে তুলে নিচ্ছে। এদিকে আমার অবস্থাও অন্যদের মতো যায় যায়! ওপরের করিডরটা তখন স্বর্গের মতো লাগছিল! কখন উঠতে পারব!

আরও প্রায় ১৫ মিনিট পর যখন পুলিশ আমাকে তুলে দিল, তখন দাঁড়ানোর শক্তি নেই। বসে পড়লাম করিডরের মেঝেতে। গলা ফেটে যাচ্ছিল পিপাসায়। আরও কয়েকজনকে দেখলাম আমার মতোই বসে হাঁফাচ্ছে, দুই পা এগোলেই সোনার হরিণ টিকিট, কিন্তু পায়ে কারও শক্তি নেই!

এরই মধ্যে দেখলাম আমার এক বড় ভাই সুপারিগাছ বেয়ে দোতলায় ওঠার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখেই বললেন, সুফল আমার জন্যও দুটি টিকিট নিয়ো। আমি বললাম, ভাই আমাকে আগে পানি দেন দয়া করে। এমন সময় পুলিশ সুপারিগাছ ধরে ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করল, উনি নেমে যেতে বাধ্য হলেন।

কিছুক্ষণ পর আমি দুই ম্যাচের সাতটি টিকিট কিনে বিজয়ীর হাসি হেসে বেরিয়ে এলাম! আমার টিকিটওয়ালা হাতের দিকে মানুষের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমি বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে হাতে নিয়ে বের হয়েছি!

এরপর ঢাকাতেও বেশ কয়েকবার রীতিমতো যুদ্ধ করে টিকিট করেছি, মাথায় পানি ঢেলেছি, সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়েছি টিকিটের জন্য!

আমি আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে একাত্মা। জয়ে-পরাজয়ে-হ্যাটট্রিকে কিংবা চিৎকারে। আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গেই সব সময়। আমি তো লাল-সবুজেরই একজন! সাকিব-তামিম-মুশফিকদের সঙ্গে হাসি, কাঁদি, স্বপ্ন দেখি। দল হেরে গেলে দীর্ঘশ্বাসগুলো তাই পরাজয়ের নয়, ওদের কান্নামাখা চাহনি দেখে স্বাভাবিক নিশ্বাস থাকাটা কি অস্বাভাবিক নয়? ভাইয়ের কান্নায় ভাই তো কাঁদবেই!

মাহদী জামান

বগুড়া