মোস্তফা হোসেইনের একাত্তরের খেরো খাতা

মোস্তফা হোসেইন। ছবি: খালেদ সরকার
মোস্তফা হোসেইন। ছবি: খালেদ সরকার

পকেট ডায়েরিটা পুরোনো; মলাট নেই। কাগজের কিছু পাতার স্বাভাবিক রং চটে গেছে, ছিঁড়েও গেছে কয়েকটা। ডায়েরির প্রথম পাতা ওলটালেই লেখকের পরিচিতি। সেখানে লেখা—‘নাম: মোস্তফা হোসেইন; ঠিকানা: চান্দলা সরকার বাড়ি, ডাকঘর: চান্দলা বাজার, চান্দলা, কুমিল্লা, পূর্ব পাকিস্তান।’ তবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটা এক টানে কেটে, নিচে আলাদা শব্দে লেখা হয়েছে: ‘বাংলা দেশ’।

সেই ডায়েরির লেখক মোস্তফা হোসেইনের সঙ্গে দেখা কিছুদিন আগে। ডায়েরির স্ক্যান করা কপি তাঁর হাতে। পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন,  ‘এটি ১৯৭১ সালের। তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। পড়াশোনা করেছি আমাদের গ্রামের স্কুলেই। ডায়েরিটা সেই সময়ে লেখা। দেশ স্বাধীন হলে পূর্ব পাকিস্তান কেটে বাংলাদেশ লিখেছি।’

ডায়েরির প্রতিটি পাতায় ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে লিখেছেন মোস্তফা হোসেইন। বছরটা যেহেতু একাত্তর; তাই ডায়েরির প্রতিদিনের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে মফস্বলের আন্দোলনমুখর সময়, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, সম্মুখসমর, হত্যাযজ্ঞ, শরণার্থীদের দুঃখগাথাসহ যুদ্ধদিনের কথা।

প্রতি দিনের ঘটনা এভাবেই লেখা আছে মোস্তফা হোসেইনের ছোট ডায়েরিতে
প্রতি দিনের ঘটনা এভাবেই লেখা আছে মোস্তফা হোসেইনের ছোট ডায়েরিতে

এমন একটি দিনের লেখাই তখন পড়ছিলাম। দিনটি ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, বুধবার। সে দিনের ঘটনায় মোস্তফা হোসেইন লিখেছেন, ‘আজ সকালে উত্তরপাড়ার ফজলুদের বাড়িতে মিলিটারিরা আস্তানা গাড়ে। বাড়িতে উঠাকালীন মুক্তিবাহিনীর লোকেরা প্রায় ১০ জনকে হত্যা করে। গ্রামে অবশ্য এরা ঢুকতে পারত না, যদিই না ফরিদপুরের কমান্ডার ছাড়া দলটা যুদ্ধে অরাজি না হতো। বিকেলে মূল যুদ্ধ আরাম্ভ হয়, যার ফলে বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। চাচি, দিলু, নার্গিস আপাকে চারি পাড়া দিয়ে আসি।’

তাঁর পকেট ডায়েরির প্রতিটি পৃষ্ঠা দুই-দিনে ভাগ করা, লেখার জায়গাটুকু খুবই ছোট। তাই দিনের সবচেয়ে আলোচিত বা মর্মস্পর্শী ঘটনার কথাই লেখা হয়েছে সংক্ষিপ্তভাবে। কিন্তু সামনে বসা লেখক শোনাতে থাকলেন সংক্ষিপ্ত ঘটনার বিষদ বর্ণনা; প্রতিটি দিনের আরও অনেক কথা। এভাবে পৃষ্ঠা ওলটালেই মোস্তফা হোসেইনের চোখে জ্বলজ্বল করে উঠছিল সে দিনটি। তাঁর কথায় জানা হচ্ছিল, গ্রামে তাঁদের যৌথ পরিবার সম্পর্কে; ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা; পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ নিয়ে গ্রাম ছাড়ার ঘটনা; ভারতের শরণার্থীশিবিরে ঘোরার অভিজ্ঞতা আর আছে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার কথা। এভাবেই একসময় পেয়েছেন মুক্তির সুবাতাস।

পকেট ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা
পকেট ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা



তিনি ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে লেখা শুরু করেছিলেন। সে দিনের অংশে দুই সারিতে ইংরেজিতে লিখেছেন ‘গ্রিটিংস দ্য নিউ ইয়ারস ডে’। এরপর ২ থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অংশটুকু ফাঁকা। ৫ তারিখের অংশে একটি পাখির ছবি আঁকা; আবার ৬ জানুয়ারি  ফাঁকা। এর পরের পাতাগুলোয় অবশ্য প্রায় নিয়মিতই লেখা হয়েছে। অধিকাংশ লেখা তিনি বাংলায় লিখেছেন, তবে ইংরেজিতেও কয়েকটি দিনের ঘটনা লেখা আছে। মোস্তফা হোসেইন বললেন, ‘ইংরেজিতে ডায়েরি লেখার একটা চল ছিল তখন। আমার দাদা বসারত আলী সরকার ডায়েরি লিখেছিলেন। তবে আমার কৈশোরে লেখা সেসব ইংরেজিতে যথেষ্ট ভুল ছিল।’

মোস্তফা হোসেইনের বয়স এখন ৬২ বছর। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের গবেষণা সম্পাদক পদে চাকরি করেন। গবেষণা করেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তিনি বলছিলেন, ‘২০ কি ২২ বছর পর্যন্ত ডায়েরি লেখার চর্চা ছিল। তারপর ব্যস্ততায় সেই অভ্যাস আর ধরে রাখা হয়নি। এর মধ্যে গ্রাম ছেড়ে যখন ঢাকায় আসি, তখন সংগ্রহগুলো সঙ্গে আনি। একসময় ভুলেই গিয়েছিলাম ডায়েরিটার কথা। বাসার পুরোনো আলমিরাটায় পারিবারিক কিছু স্মৃতিস্মারক আর দুষ্প্রাপ্য কিছু সংগ্রহও আছে। এই সংগ্রহ থেকে পুরোনো একটি রেডিও খুঁজতে গিয়ে নজরে পড়ে পকেট ডায়েরিটা।’

হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটি ২০১৬ সালের। সে ডায়েরিটা তিনি গত বছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেছেন। ব্যক্তিগত ডায়েরিটা শুধু তাঁর একার থাকেনি, এখন সেটা যুদ্ধদিনের স্মারক।