মরুর দেশে বাংলা ভাষা

‘তুমি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছ?’

প্রশ্নটা শুনেই পাশ ফিরে তাকালাম। আমার চোখে তখন বিস্ময়। একি! দেখে তো বাংলাদেশি মনে হচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ড লাগল উত্তর দিতে, ‘হ্যাঁ।’ এবার সে বলল, ‘আমার অনেক বন্ধু আছে বাংলাদেশের।’ কৌতূহলের পিপাসা থামিয়ে আমার প্রশ্ন, ‘তুমি কোন দেশের?’ উত্তরে বলল, ‘মিসর’।

মনে মনে বিড়বিড় করছি, ১০ কি ১১ বছরের মেয়েটা এত ভালো বাংলা কী করে জানে? সে উত্তর অবশ্য ততক্ষণে পেয়েছি। জুদাইনার মতো সেখানে পরিচিত হওয়া কেনিয়ার শাঙ্গজয়, মিসরের নওরিন। এরা প্রত্যেকেই কথা বলছে বাংলায়। সবাই ওমানের রাজধানী মাসকাটে ‘বাংলাদেশ স্কুল’-এর শিক্ষার্থী।

শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে।  ছবি: সংগৃহীত
শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে। ছবি: সংগৃহীত

সে বিস্ময়ের ঘোর না কাটিয়েই করিডর পেরিয়ে হলরুমে ঢুকে পড়ি। আওয়াজ ভেসে এল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা গাইছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। মঞ্চে অনেক মুখের ভেতর কয়েকজনকে দেখেই বোঝা গেল তারা বাংলাদেশি নয়। জানলাম, বাংলাদেশ ছাড়াও সেই মঞ্চে আছে আরও চার দেশের ছাত্রছাত্রী। জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে এ যেন রূপ নিয়েছে বহু দেশের মেলবন্ধনে। মাসকাটে এই বাংলাদেশ স্কুল নিয়ে এবার খোঁজখবরের পালা।

ওমান সরকার-স্বীকৃত বাংলাদেশিদের স্কুল এটি। শিক্ষার মাধ্যম মূলত ইংরেজি। তবে শিক্ষার্থীরা চাইলে বাংলাকেও বিষয় হিসেবে নিতে পারে। পড়াশোনা করছে ১৭টি দেশের ১ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী। শুধু তাই নয়, এডএক্সেল সিলেবাসে পরিচালিত স্কুলগুলোতে র‍্যাঙ্কিং বিচারে শুধু ওমান নয়, মধ্যপ্রাচ্যেও প্রতিবছর সেরা দশে জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষকদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশি। তবে পাঠদান করছেন আরও পাঁচ দেশের শিক্ষক। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মেজর (অব.) নাসির উদ্দীন আহমেদের ভাষায়, ‘যদিও আমরা প্রবাসে আছি। তবু এটি যেন একখণ্ড বাংলাদেশ। পয়লা বৈশাখে এখানে এলে কারও মনেই হবে না তিনি দেশের বাইরে আছেন।’

সাংস্কৃতিক আয়োজনে নৃত্য পরিবেশন করছে ওমানের বাংলাদেশ স্কুলের শিক্ষার্থীরা
সাংস্কৃতিক আয়োজনে নৃত্য পরিবেশন করছে ওমানের বাংলাদেশ স্কুলের শিক্ষার্থীরা

তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ই চলে এল দুজন শিক্ষার্থী। জানতে চাইলাম, ‘বাংলায় গান পারো?’ অবাক করে দিয়ে তারা ধরল, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি।’ অনেক বিদেশিই তো বাংলায় কথা বলতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে কজনের মুখে তা এতটা স্পষ্ট হবে, তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। তাদের এই বাংলা বলার রহস্য জানতেও সময় লাগল না। ইরানের আহলিয়াই পরিষ্কার করে দিল, ‘বন্ধুদের মুখে বাংলা শুনে শুরুতে আগ্রহ হয় আমার। পরে শিক্ষকদের কাছে শিখেছি।’ বুঝলাম ভালোবাসার টানেই এটা সম্ভব হয়েছে তাদের। তবে শিক্ষকদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

তাদের কথা শুনতে শুনতেই স্কুলের হলরুম থেকে সুর ভেসে আসছে, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’। সেই ‘আমার অহংকার’ কথাটা যারা বলছিল, তাদের অনেকেই ভিনদেশি, যাদের ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতিও ভিন্ন। তবে ‘বাংলাদেশ স্কুল’ তাদের নিয়ে এসেছে এক জায়গায়। ভালোবাসার মায়ায় বেঁধেছে বর্ণমালায়। সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষা যখন হাজার মাইল দূরে ভিনদেশিদের মুখেও শোনা যায়, তখন গর্ব হয়।

এস এম আশরাফ

ঢাকা