ছবিই তোলেন সাবাহ

ফিরোজ আল সাবাহ। ছবি: সংগৃহীত
ফিরোজ আল সাবাহ। ছবি: সংগৃহীত

খুঁটির মাথায় জুড়ে দেওয়া ছোট এক ফালি কাঠে তিন শব্দের সতর্কীকরণ নির্দেশনা, ‘মাছ ধরা নিষেধ’। এমন কড়া নির্দেশনার ওপরই ঠোঁটে মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে মাছরাঙাটি। তার আয়েশি ভাবটা যেন এমন, এসব নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা সে করে না! ফেসবুকেই জেনেছি বিরল মুহূর্তের ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ। সে ছবি তোলার গল্প বিবরণেই তিনি লিখেছেন। তবু আগ্রহ নিয়ে সে গল্পই নতুন করে শুনছিলাম, ‘টানা সাত মাস রোজ বিকেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকার পর ছবিটি তুলতে পেরেছিলাম।’

সকালের সূর্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালি চূড়ার ছবিটি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে তুলেছেন ফিরোজ আল সাবাহ
সকালের সূর্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালি চূড়ার ছবিটি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে তুলেছেন ফিরোজ আল সাবাহ

ফিরোজ আল সাবাহ শখের আলোকচিত্রী। ক্যাননের ইওএস ৭ডি ক্যামেরা হাতে প্রকৃতি, পাখি ও বন্য প্রাণীর ছবি তোলেন। এক ফাঁকে জেনেছি, দেশের ৪০টি জেলা ঘুরে প্রায় ৩৯০ প্রজাতির পাখি ক্যামেরাবন্দী করেছেন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ২৮ বছর বয়সী এই তরুণ। ছবি তোলা ছাড়াও তিনি নিজ এলাকায় কাজ করছেন প্রাণী সংরক্ষণে মানুষকে সচেতন করতে। ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সাবাহ মনের আনন্দে ছবি তুলবেন বলে এলাকা ছাড়েননি। পারিবারিক ব্যবসা আর কৃষিজমি দেখাশোনার ফাঁকে ছুটে বেড়ান ক্যামেরা কাঁধে।তাঁর জীবনগল্প শুনে মনে হলো, তিনি আপাদমস্তক ছবির মানুষ, ছবির কবি। কবিতার মতোই ছবিগুলোর পেছনে আছে অনবদ্য একেকটি গল্প। এই যেমন কয়েক মাস আগেই তিনি ফেসবুক প্রোফাইলে কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। সবুজ মাঠে আলপথ ধরে লাঙল-জোয়াল কাঁধে হেঁটে যাচ্ছেন একজন কৃষক, তাঁকে ছাপিয়ে সামনে দেখা যাচ্ছে ভোরের আলোয় সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। হিমালয় পর্বতমালার কোনো কোনো চূড়া পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে দেখা যায়, এটি পুরোনো কথা। কিন্তু সাবাহর তোলা ছবিটি ভাবনার খোরাক জোগায়, চোখকে স্বস্তি দেয়।

মাছরাঙার ভাবখানা যেন—আমি মানি নাকো কোনো মানা! ফিরোজ আল সাবাহ ছবিটি তুলেছেন সাত মাসের চেষ্টায়
মাছরাঙার ভাবখানা যেন—আমি মানি নাকো কোনো মানা! ফিরোজ আল সাবাহ ছবিটি তুলেছেন সাত মাসের চেষ্টায়

সাবাহ বলতে থাকেন, ‘বিভিন্ন সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলতে তেঁতুলিয়ায় গিয়েছি। তবে এই ছবি আগেরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। ভোরের আলো ফোটার ক্ষণে মাত্র ১০ মিনিটের মতো এই অপূর্ব দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়। এর মধ্যেই ছবি তুলতে হয়। সময় বিবেচনায় তাই আগের দিন গিয়েই স্থান নির্বাচন করে আসতে হয়। সেদিনও তা-ই করেছিলাম। আর ভোর পাঁচটায় গিয়ে ক্যামেরা তাক করতে হয়েছিল।’শুধু পর্বতচূড়ার এই ছবিই নয়, বাড়ির কাছের এক শিয়াল পরিবারের ছবি তুলতে গিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়েছিল তাঁকে। দিনে দিনে খেঁকশিয়াল পরিবারের বিভিন্ন রকম ছবি তুলতে থাকেন। এর মধ্যে আড়মোড়া ভাঙার ছবিটি নিয়ে ফেসবুকে প্রশংসার বন্যায় ভেসেছেন সাবাহ। প্রশংসা পেয়েছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকেরও। প্রতি সপ্তাহে নির্বাচিত ২৫টি বন্য প্রাণীর ছবি তুলে দেওয়া হয় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ওয়েবসাইটে। ফিরোজ আল সাবাহর তোলা ছবিও স্থান পেয়েছিল সে তালিকায়। এই কথার সঙ্গে সম্পূরক তথ্য যোগ করে বললেন, ‘শুধু একবার নয়, এই বিভাগের জন্য ছয়বার নির্বাচিত হয়েছিল আমার ছবি।’

আড়মোড়া ভাঙছিল খেঁকশিয়ালটি
আড়মোড়া ভাঙছিল খেঁকশিয়ালটি

ছবির জন্য সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের পঞ্চগড় অঞ্চলের ‘শ্রেষ্ঠ ওয়াইল্ডলাইফ’ আলোকচিত্রীর। তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন আলোকচিত্র উৎসবে। সাবাহ বললেন, ‘পুরস্কার বা প্রদর্শনী নয়, আমি ছবি তুলি নিজের জন্য।’

বসন্তবাউরি
বসন্তবাউরি

ফিরোজ আল সাবাহ সম্পর্কে পুরোটা জানার পর কথাটি বাড়িয়ে বলা কিছু মনে হয়নি। নিজের জন্য ছবি তোলেন বলেই হয়তো ছবি তোলার চর্চাটাও করেছেন নিজেই। সাবাহ বললেন, ‘আসলে গত ছয় বছর ক্যামেরা আর ছবি ছাড়া বলার মতো কিছু নেই। পড়াশোনাও থামিয়ে দিয়েছিলাম। আর আলোকচিত্রবিষয়ক ডিগ্রি নেওয়া প্রয়োজন মনে করিনি। সত্যি বলতে, ইন্টারনেট থাকলে কিছুতে আটকায় না। শেখার জন্য বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রীদের নিবন্ধ পড়েছি, কিছু জানার থাকলে ইউটিউবে বিষয়ভিত্তিক টিউটোরিয়াল দেখে শিখে  নিয়েছি।’

স্বশিক্ষিত এই আলোকচিত্রী ছবি নিয়েই থাকতে চান; চান নিজের জেলা পঞ্চগড়ের রূপবৈচিত্র্য সবার সামনে তুলে ধরতে।

স্নান সারছিল বাবুই বাটান
স্নান সারছিল বাবুই বাটান