কী চমৎকার দেখা গেল

বায়োস্কোপ দেখাচ্ছেন নেফাজ আলী। ছবি: সোয়েল রানা
বায়োস্কোপ দেখাচ্ছেন নেফাজ আলী। ছবি: সোয়েল রানা

‘আআআ...রে, কী চমৎকার দেখা গেল/ নজর করে দেখো ভালো/ গাঁয়ের বধূ নাইওর এল/ তার পরেতে দেখা গেল/ যমুনায় পানি এল/ কী চমৎকার দেখা গেল/ সরকারবাড়ি ভাইসা গেল/ কুতুব মিনার হেলে গেল/ এই বারেতে দেখেন ভালো/ ঢাকা শহর দেখা গেল/ শেখ মুজিবুর আইসা গেল/ একাত্তরের যুদ্ধ হলো...।’

এক হাতে বায়োস্কোপের শলাকা ঘোরাচ্ছেন, অন্য হাতে কাঠের খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে সুর তুলছেন নেফাজ আলী। কাঠের বক্সের সামনের অংশে কাচ বসানো ছয়টি মুখের ঢাকনায় তখন একচোখা হয়ে মুগ্ধ ছয় খুদে দর্শক।

বায়োস্কোপওয়ালা নেফাজ আলী। এভাবেই সুর-ছন্দে হেলেদুলে নেচে বায়োস্কোপ দেখাচ্ছেন ৬৩ বছর ধরে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি, দেখা হয়েছিল বগুড়া শহরে এক বৈশাখী মেলায়। নেফাজ আলী বললেন, ‘এই বায়োস্কোপের বয়স ১৩৩ বছর। চাচাজানের কাছে ছিল ৭০ বছর; আমার কাছে আছে ৬৩ বছর ধরে।’ বায়োস্কোপওয়ালা নেফাজ আলী সন্তানের মতোই দরদ দিয়ে আগলে রেখেছেন বাক্সটি। এই বায়োস্কোপ দেখানোর রোজগারেই সংসার চলে তাঁর।

শুরুটা তাঁর চাচার হাত ধরে; তখন বয়স সবে ১১ বছর। চাচা গেদা বয়াতি এলাকার পথঘাট-অলিগলি ঘুরে বায়োস্কোপ দেখাতেন। চাচার পিছু পিছু ঘুরতেন তিনি। গ্রামগঞ্জে বায়োস্কোপ দেখিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নেফাজকে গঞ্জের দোকান থেকে একটা লজেন্স আর এক আনার লই মিঠাই কিনে দিতেন গেদা বয়াতি। চাচা মারা গেলে সেই বায়োস্কোপই দেখানো শুরু করেন নেফাজ আলী। এখনো সে বায়োস্কোপই তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন।

বায়োস্কোপওয়ালা নেফাজ আলী
বায়োস্কোপওয়ালা নেফাজ আলী

নেফাজ আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর গ্রামের অলিগলি ঘুরে বায়োস্কোপ দেখাতাম। পর্দায় তখন দেখানো হতো মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য। সেই দৃশ্য দেখতে বায়োস্কোপের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ত ছেলে-বুড়োরা। বায়োস্কোপ শেষ হলে আবেগে চোখ মুছত। লোকজন খুশি হয়ে ধান, চাল, ডালসহ খেতের শস্য ঢেলে দিত। চারদিকে তখন এই বায়োস্কোপের কত কদর। এখন দিন পাল্টেছে। তেমন দর্শক মেলে না।’

তবু জীবিকার প্রয়োজনে, কাঠের এই বাক্সটার প্রতি ভালোবাসার টানে বায়োস্কোপ নিয়ে পথে পথে ঘোরেন। গ্রামে-গঞ্জে যান। বৈশাখী মেলায় ডাক পড়ে। মেলায় এলে রোজগার কিছুটা ভালো হয়। বায়োস্কোপের আয় দিয়েই ছোট আট বোন আর দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। নেফাজ বলেন, ‘৬৩ বছরে দর্শক বদলেছে। বদলায়নি শুধু এই বায়োস্কোপ। তবে আগে টিনের মুখ ছিল, এখন তার বদলে স্টিলের তৈরি শিশুদের টিফিন বক্স কেটে মুখে বসিয়েছি।’

এক বায়োস্কোপওয়ালার জীবনকাহিনি নিয়ে তৈরি বাপজানের বায়োস্কোপ ছবিটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছেন নেফাজ আলী। ছবিটা দেখে নাকি তাঁর নিজের গল্প বলেই মনে হয়েছে। এমন কথোপকথনের ফাঁকেই নেফাজ আলীর বায়োস্কোপের সামনে দর্শকের ভিড় বেড়ে গেল। বায়োস্কোপওয়ালা হেলেদুলে গাইতে শুরু করলেন, ‘কী চমৎকার দেখা গেল/ রহিম রূপবান আইসা গেল/ ঢাকার শহর দেখেন ভালো/ কী চমৎকার দেখা গেল...।’