সাইবেরীয় নীল দোয়েল

পুরুষ সাইবেরীয় নীল দোয়েল। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে, ৬ মার্চ ২০১৮।  ছবি: লেখক
পুরুষ সাইবেরীয় নীল দোয়েল। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে, ৬ মার্চ ২০১৮। ছবি: লেখক

ডরমিটরি থেকে বেরিয়ে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বুনো পথে প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর বনের গভীরে ছোট্ট এক পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ালাম। প্রায় শুকনো পুকুরটির বেশির ভাগ অংশজুড়েই গাছের কাটা ডালপালা ছড়ানো। আমাদের কাছে এমন একটি পুকুরের তেমন কদর না থাকলেও বনের পাখি-প্রাণীদের কাছে এর গুরুত্ব কতটুকু, তা মাত্র তিন ঘণ্টায় ভালোই টের পেয়েছি। এখানেই গত ৬ মার্চ ২৬ প্রজাতির পাখির দেখা পেয়েছিলাম, যার অন্তত ৫-৬টি ছিল বিরল। এদের মধ্যে অতি বিরল এক জোড়া পাখি নিয়েই আজকের গল্প।

নীল-সাদা ছোট্ট পুরুষ পাখিটি পুকুরপাড়ে এল। বিকেল ৫টা ১৬ মিনিটে এসে পাখিটি ২০ সেকেন্ডের কম সময় থাকল। এরপর আচমকা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। স্ত্রী পাখিটি স্পটে এল ঠিক ৫টা ২২ মিনিটে। থাকল এক মিনেটের কম। মিনিটখানেক পর আবারও এল, থাকল প্রায় দুই মিনিট। এরপর আরও দুবার এল। এর মধ্যে পাখিটি দুবার গোসলও করল। কিন্তু পুরুষটিকে আর দেখা গেল না, এমনকি পরের দিনও না।

এরা হলো বিরল পরিযায়ী পাখি সাইবেরীয় নীল দোয়েল। নীল গুম্পিগোরা নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম সাইবেরিয়ান ব্লু রবিন। মিউজিক্যাপিডিয়া পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Larvivora cyane। সূত্রমতে, ২০১৩ সালে এই পাখির প্রথম দেখা মেলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। পরে সাতছড়িতে দেখা যায় ২০১৩-২০১৫ ও ২০১৭ সালে। এ ছাড়া দেশের আর কোথাও দেখা যায়নি। এ বছর সম্ভবত দুবার এদের দেখা মিলল।

সাইবেরীয় নীল দোয়েল ছোট্ট আকারের পাখি। দৈর্ঘ্য ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১১-১৮ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষের চেহারায় বিস্তর পার্থক্য। মাথাসহ পুরুষের দেহের ওপরটা উজ্জ্বল নীল। গলা ও বুকের দুপাশ কালচে। দেহের নিচটা পুরোপুরি সাদা। অন্যদিকে স্ত্রীর দেহের ওপরটা জলপাই-বাদামি। গলা ও বুক হালকা হলদে। বুকে গাঢ় বাদামি ফোঁটা। কোমর সচরাচর নীল। কোনো কোনোটার লেজও নীল। দেখতে কতকটা দেশি নীল দোয়েলের মতো হলেও বুক-পেট কমলা-হলুদ। স্ত্রীর ফ্যাকাশে দেহের তুলনায় চোখ বেশ গাঢ়। অল্পবয়স্ক পুরুষ পাখি স্ত্রীর মতোই, তবে বাজু ও মাথায় কমবেশি নীল দেখা যায়। অল্পবয়স্ক স্ত্রী দেখতে প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীর মতোই। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষ লেজ খাটো, পা লম্বা ও চোখের চারদিকে অনিয়মিত সাদা দাগ।

সাইবেরিয়া নীল দোয়েল বিরল পরিযায়ী পাখি। মূল আবাসভূমি সাইবেরিয়াসহ রাশিয়ার মধ্য ও পূর্বাঞ্চল, জাপান, কোরিয়া এবং চীন, মঙ্গোলিয়া ও কাজাখস্তানের কিছু এলাকা। শীতে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপালসহ দ‌ক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ইন্দোনেশিয়ায় পরিযায়ী হয়। যদিও এ দেশে এত দিন শুধু সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনেই এদের দেখা গেছে, কিন্তু অতি সম্প্রতি কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বড় ছড়ায়ও দেখা গেল। এরা সান্ধ্যচারী। সচরাচর একাকী থাকে, কদাচ জোড়ায় দেখা যায়। ঘন ঝোপঝাড় ও বনতলে বিচরণ করে বলে সহজে নজরে আসে না। মাটিতে হেঁটে হেঁটে কীটপতঙ্গ খায়। পাকা ফল এবং ঘাসবিচিও খায়। প্রজনন মৌসুমজুড়ে পুরুষ পাখি উঁচু ও কাঁপা কাঁপা স্বরে দ্রুত ‘ট্রি-ট্রি-ট্রি-ট্রি’ শব্দে ডাকতে থাকে।

 রাশিয়ায় এদের প্রজননকাল জুন-জুলাই ও চীন-জাপানে মে-জুন। ঝোপঝাড়পূর্ণ বনাঞ্চল, বিশেষ করে বনের প্রা‌ন্তে বা নদীর ধারে ঘন ঝোপঝাড়ে বাসা করে। সচরাচর গাছের গোড়া বা কোনো নিরাপদ স্থানে গোপনে শুকনো পাতা, ঘাস ও মস দিয়ে ছোট্ট বাটির মতো বাসা বানায়। ডিম পাড়ে দু-পাঁচটি। ডিমের রং নীলচে; তাতে কিছু কালচে ছিট থাকতে পাড়ে। ডিম ফোটে মাত্র ১২ দিনে। আয়ুষ্কাল চার বছরের কিছু বেশি।