গবেষণা দলে আমাদের সন্ধি

বাংলাদেশি গবেষক আরিফিন সন্ধি। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশি গবেষক আরিফিন সন্ধি। ছবি: সংগৃহীত

মধ্য এপ্রিলের কথা। যুক্তরাজ্যের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হলো একটি খবর। সে খবরটির বিষয়বস্তু বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘সায়েন্স ডাইরেক্ট’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ। এক প্রজাতির শেওলা ব্যবহার করে কীভাবে জলাশয়ের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নিরাপদ ও সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা যায়, সেটাই হলো প্রবন্ধের বিষয়। প্রতিবেদনটি পড়তে গিয়ে নজর কেড়েছিল একজন ব্যক্তির নাম। তিনি বাংলাদেশের আরিফিন সন্ধি। সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তিনজন গবেষক মিলে গবেষণার কাজটি করেছেন, সন্ধি তাঁদেরই একজন।

আরিফিন সন্ধির সঙ্গে যোগাযোগ হলো ই-মেইলে। গবেষণার এমন কাঠখোট্টা বিষয়টি তিনি বোঝালেন সহজ ভাষায়—অতিমাত্রায় আর্সেনিকসমৃদ্ধ পানি পান করে মানুষ যেমন আর্সেনিক আক্রান্ত হয়, তেমনি খনি থেকে বিভিন্ন আকরিক সংগ্রহ করার সময় এবং ভূগর্ভস্থ পানি সেচকাজে ব্যবহারের সময় আর্সেনিক মাটি থেকে পানিতে ছড়িয়ে পড়ে, যা থেকে খাদ্যশস্যের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে ক্যানসারসহ নানা রোগ হতে পারে। বিষয়টি নিয়েই গবেষণা শুরু করলেন আরিফিন সন্ধি ও তাঁর দল। দল বলতে সন্ধি, সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষণা পরামর্শক মারিয়া গ্রেগার ও টমি ল্যান্ডবার্গ। ড. সন্ধি বললেন, ‘রাসায়নিক দিক থেকে লোহার সঙ্গে আর্সেনিকের একটি জোরালো সম্পর্ক আছে। সুইডেনে লোহার খনি আছে প্রচুর পরিমাণে। এই খনিগুলোর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আর্সেনিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আমরা একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উপায় খুঁজছিলাম।’

এই বিশেষ প্রজাতির শেওলা নিয়েই হয়েছে গবেষণা
এই বিশেষ প্রজাতির শেওলা নিয়েই হয়েছে গবেষণা

সন্ধান পেলেন শেওলার

২০১২ সালের কথা। সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন সন্ধি। তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল পানির আর্সেনিকের দূষণ এবং সেটা কীভাবে অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধি বললেন, ‘গবেষণার দুই বছরের মাথায় চিন্তা করলাম, আর্সেনিকের সমস্যা পানিতে তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই আমাদের জলজ উদ্ভিদের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। তারপর থেকেই আমরা মূলত  একাধিক জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করি। সুইডেন থেকে উত্তর ইউরোপের একাধিক দেশ থেকে সংগৃহীত শেওলা স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়।’

সুইডেনের উত্তরাঞ্চলের স্কেলেফটিয়া এলাকায় গবেষণা জরিপ করার সময় এক প্রজাতির শেওলার দেখা পেয়েছিলেন সন্ধিরা। যে জলজ উদ্ভিদগুলো আর্সেনিকসমৃদ্ধ পানির স্রোতে থেকে বিপুল পরিমাণ আর্সেনিক নিজেদের মধ্যে  নিয়ে নেয়।

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম। সেখানে  ৭০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিকসমৃদ্ধ প্রতি লিটার পানিতে এই শেওলা ব্যবহার করার মাধ্যমে আর্সেনিকের মাত্রা এক ঘণ্টার মধ্যে ৩০ মাইক্রোগ্রামে নেমে আসে। ইতিবাচক ফল পেয়ে উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রকল্প। শুরুতে অনেকে গবেষণার সাফল্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবু থেমে থাকেনি গবেষক দল। সুইডেনের পরিবেশ প্রকৌশল ফাউন্ডেশন এগিয়ে এল অনুদান নিয়ে। শুরু হলো গবেষণার কাজ।

ড. সন্ধির সঙ্গে গবেষণা দলের বাকি দুই সদস্য—মারিয়া গ্রেগার ও টমি ল্যান্ডবার্গ
ড. সন্ধির সঙ্গে গবেষণা দলের বাকি দুই সদস্য—মারিয়া গ্রেগার ও টমি ল্যান্ডবার্গ

একজন আরিফিন সন্ধি

আরিফিন সন্ধির বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল মালেক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী মা শাহানা পারভীনের দুই সন্তানের মধ্যে সন্ধি বড়। পড়াশোনা ঢাকার ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুল ও ঢাকা কলেজে। স্নাতক করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চশিক্ষার জন্য ২০০৯ সালে যান সুইডেনে। সেখানকার স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস্তুবিদ্যা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এরপর সুইডেনের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে পানিসম্পদ প্রকৌশলে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ২০১৭ সালে। এখন সুইডেনের লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য ও জীববিজ্ঞান অনুষদে গবেষক হিসেবে কাজ করেন আরিফিন সন্ধি। এ ছাড়া পরিবেশে ভারী ধাতব মৌলের উপস্থিতি এবং পরিশোধনের উপায় নিয়ে একাধিক যৌথ প্রকল্পে কাজ করছেন সুইডেনসহ জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। চিকিৎসক স্ত্রী নাসরিন হককে নিয়ে তাঁর বাস সুইডেনের স্টকহোম শহরে।

সন্ধিদের গবেষণা নিয়ে ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত খবর
সন্ধিদের গবেষণা নিয়ে ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত খবর

দেশেও হোক গবেষণা

বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার আর্সেনিকের সমস্যা অনেক আগের। খাওয়ার পানির পাশাপাশি আর্সেনিক ইতিমধ্যেই খাদ্যশস্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, যা শুধু আর্সেনিক উপদ্রুত এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, খাবার সরবরাহের মাধ্যমে বরং দেশের অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশে ক্রমবর্ধমান ক্যানসারসহ অন্যান্য জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর্সেনিক। বাংলাদেশেও পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আর্সেনিক দূরীকরণের প্রক্রিয়া চালু করার  ইচ্ছে সন্ধির। সেই ইচ্ছা পূরণ করার জন্য তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছেন। বললেন, ‘আমার এই গবেষণার মূল লক্ষ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আর্সেনিক আক্রান্ত লাখো মানুষের সমস্যা সমাধান করা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রচুর পরিমাণে উপযোগিতা রয়েছে। তাই দ্রুত গবেষণার কাজ শুরু করা উচিত।’