স্পটার আশিকুর

ছবি তুলতে নেদারল্যান্ডসে
ছবি তুলতে নেদারল্যান্ডসে

ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল পাইলট হবেন। কিন্তু বড়বেলায় এসে দেখলেন, পাইলট হতে যে ধৈর্য ও পরিশ্রম দরকার তা নেই আশিকুর রহমানের। তাই বলে তিনি অবশ্য উড়োজাহাজকে জীবন থেকে বিদায় জানালেন না। সে সময় দেখলেন, তঁার বড় ভাইয়ের দুই বন্ধু ক্যামেরা নিয়ে উড়োজাহাজের ছবি তোলেন। বাহ্‌! ব্যাপারটা তো দারুণ! আশিকুরের মনে ধরল বিষয়টা। তিনি ভাইয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে জানলেন, এভাবে যাঁরা উড়োজাহাজের ছবি তোলেন তাঁদের বলা হয় ‘স্পটার’। স্পটাররা মূলত বিভিন্ন ধরনের উড়োজাহাজের গায়ে লেখা নিবন্ধন নম্বর সংগ্রহ করেন, ছবি তোলেন, ভিডিও করেন। নতুন নতুন উড়োজাহাজ দেখাই তাঁদের শখ। আন্তর্জাতিকভাবে শখের এ কাজটি বেশ প্রচলিত।

ছবি তুলতে দেশে দেশে

আশিকুরও নেমে পড়লেন এই কাজে। ‘প্রথমত শখ ছিল। এখন রীতিমতো নেশা। উড়োজাহাজের ছবি তোলার চেয়ে আমি ভিডিওই বেশি করি।’ বলছিলেন আশিকুর। আমরা ভেবেছিলাম, টুকটাক উড়োজাহাজের ছবি তোলেন হয়তো, এটাকেই বলছেন নেশা। কিন্তু আশিকুর যখন জানালেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্গো উড়োজাহাজের ছবি আর ভিডিও ধারণ করার জন্য তিনি জার্মানি অবধি গিয়েছিলেন, তখন যেন এক লাফে চোখজোড়া কপালে উঠে যায় আমাদের। বলেন কী! আশিকুর হাসতে হাসতে বলেন, ‘হ্যাঁ। ঘটনাটা গত মাসের। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে আমার কয়েকজন বন্ধু থাকে। তারা হঠাৎ একদিন জানায় যে জার্মানির লিপজিগ-হালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘আন্তনভ এন-২২৫ ম্রিয়া’ উড়োজাহাজ অবতরণ করবে। আসবি নাকি? আসব না মানে? বলে কী! এ সুযোগ কি বারবার পাওয়া যাবে? তল্পিতল্পা গুছিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই উড়াল দিই জার্মানির উদ্দেশে। সেখানে ৩, ৪ ও ৬ এপ্রিল তিন দিনে তিনবার ওঠানামা করেছে উড়োজাহাজটি। আমি বেশ কয়েকটি ভিডিও ধারণ করতে পেরেছি।’

বোঝা গেল, এই উড়োজাহাজের ভিডিও ধারণ করতে পেরে ভীষণ উচ্ছ্বসিত আশিকুর। কেন এত উচ্ছ্বাস সেটাও অবশ্য ব্যাখ্যা করেন একটু পর। এই উড়োজাহাজের ছবি তোলার জন্য আর ভিডিও ধারণ করার জন্য জার্মানির বিভিন্ন শহর থেকে তো বটেও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও স্পটাররা এসেছিলেন। কারণ, এটি প্রায় ৩৩ বছর আগের এক সুপার কার্গো উড়োজাহাজ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড়। এটি সচরাচর উড্ডয়ন করে না। বিশেষ প্রয়োজনেই কেবল এটি ব্যবহার করা হয়। উড়োজাহাজটি উক্রাইনের কিয়েভ শহর থেকে চারটি জেনারেটর বহন করে নিয়ে এসেছিল জার্মানিতে। তারপর লিপজিগ-হালে বিমানবন্দর থেকে উড়ে যায় সৌদি আরবের দাম্মাম বিমানবন্দরে।

আশিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
আশিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

এই সুযোগে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় স্পটাররা জড়ো হয়েছিলেন লিপজিগ-হালে বিমানবন্দরে। তবে সবচেয়ে দূরের দেশ থেকে সম্ভবত গিয়েছিলেন আশিকুর। তিনি তাঁর স্পটার অ্যালবাম দেখাচ্ছিলেন আমাদের আর জানাচ্ছিলেন এসব তথ্য। কত রকমের, কত ধরনের, কত বাহারি সব উড়োজাহাজ। দেশ-বিদেশের। লিপজিগ-হালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরেও কিছু বিমানবন্দরের ছবি দেখা গেল। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই আশিকুর জানালেন, এ পর্যন্ত তিনি অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডসে গিয়েছেন উড়োজাহাজের ভিডিও ধারণ করতে।

ছবি তুলতেই বাড়িভাড়া

শখ বটে। আশিকুরের স্পটিং নেশার গভীরতা বোঝার জন্য যেতে হবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে বাউনিয়াতে। এখানে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন শুধুই ছাদ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে উড়োজাহাজের অবতরণ ও উড্ডয়নের ভিডিও ধারণ করার সুযোগ পাবেন বলে। বাসাটিতে আশিকুর ও তাঁর তিন স্পটার বন্ধু ছুটির দিনগুলোতে যান ভিডিও করতে আর ছবি তুলতে। আশিকুরদের একটি দলও আছে। সাত সদস্যের সেই দলের নাম ‘প্লেন স্পটার বাংলাদেশ’।

আশিকুর বলছিলেন, ‘বাইরের দেশগুলোতে স্পটিং যতটা জনপ্রিয়, আমাদের দেশে ততটা নয়। আমরা এই গ্রুপের মাধ্যমে চেষ্টা করছি স্পটিংকে জনপ্রিয় করতে। বাইরের দেশগুলোতে স্পটারদের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হয়। আমাদেরও ইচ্ছা আছে সে রকম প্রদর্শনীর আয়োজন করার।’

বাইরের দেশে আরও অনেক কিছুই হয়। বিশেষ ধরনের উড়োজাহাজের উড্ডয়ন-অবতরণের সময়সূচি আগে থেকেই স্পটারদের জানিয়ে দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, যাতে তাঁরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ছবি তুলতে পারেন, ভিডিও করতে পারেন। পৃথিবীর অনেক বিমানবন্দরই ‘ওপেন ডে’ নামে একটি বিশেষ দিন রাখে, যেদিন স্পটাররা নির্বিঘ্নে ছবি তুলতে পারেন। বিশ্বের অনেক বিমানবন্দর স্পটারদের জন্য আলাদাভাবে বিমান প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে স্পটাররা বিমানবন্দরের গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগী হিসেবেও কাজ করার সুযোগ পান। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এসব সংস্কৃতি চালু হয়নি। তবে আশিকুর আশাবাদী ‘অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশেও স্পটিং জনপ্রিয় হবে। তখন আমাদের বিমান কর্তৃপক্ষও স্পটারদের জন্য নানা উদ্যোগ নেবেন, আইনকানুন শিথিল করবেন।’

আশিকুরের গন্তব্য

শখের কথা, আশার কথা তো অনেক শোনা হলো। এবার...। আশিকুর বলেন, ‘এবার পেশার কথা শুনতে চান তাই তো?’ মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিতেই নিজের সম্পর্কে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করছি একটি বেসরকারি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে পণ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে। তার আগে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেছি। ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। বাবা মারা গেছেন; এখন মা আর ভাই-ভাবিদের সঙ্গে থাকি ‍গুলশানে। যখন খবর পাই বিশেষ কোনো উড়োজাহাজ আসছে শাহজালাল বিমানবন্দরে, তখন ছুটে যাই বাউনিয়ার বাসার ছাদে। এ ছাড়া ছুটির দিনগুলোতে নিয়মিত যাই বাউনিয়ার ভাড়া বাসায়।’

‘আন্তনভ এন-২২৫ ম্রিয়া’ নামে এই উড়োজাহাজের ছবি তুলতেই আশিকুর গিয়েছিলেন জার্মানির লিপজিগ-হালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
‘আন্তনভ এন-২২৫ ম্রিয়া’ নামে এই উড়োজাহাজের ছবি তুলতেই আশিকুর গিয়েছিলেন জার্মানির লিপজিগ-হালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে

কথা শেষ করে দম নেন আশিকুর। আপনি মানুষকে তথ্য জানাতে ভালোবাসেন তাই না? ‘ঠিক ধরেছেন। ইউটিউবে আমার একটি স্পটিং চ্যানেল আছে (https://goo.gl/MLK7yB)। এই চ্যানেলে আমি আমার স্পটিং ভিডিওগুলো আপলোড করি। আপনারা ভিডিওগুলো দেখলেই বুঝবেন আমি শুধু উড়োজাহাজের ভিডিও দিই না, সেই উড়োজাহাজ সম্পর্কে নানা তথ্য দিই। কোথায়, কখন, কীভাবে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে, সেসব তথ্যও দিই।’ বলছিলেন আশিকুর।

তিন বছর আগে ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্পটিংয়ের পথে যাত্রা শুরু করেন আশিকুর রহমান। গন্তব্য কত দূর জানেন না। শুধু জানেন, যেতে হবে বহুদূর।