মেহেদির রঙে রাঙা সামিয়া

হাতে মেহেদির এমন নকশা ফুটিয়ে তোলেন সামিয়া ছবি: সংগৃহীত
হাতে মেহেদির এমন নকশা ফুটিয়ে তোলেন সামিয়া ছবি: সংগৃহীত

সামিয়া হাসানাতের কথা জানতে পারি গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় বসে। মার্কিন সরকারের একটা আয়োজনে নানা দেশের সাংবাদিকেরা একত্র হয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় কথায় কথায় কুয়েতি সাংবাদিক আথুব এ আলশুয়াইবি জানালেন, কুয়েতে বাংলাদেশের এক মেয়ে হেনা আর্টিস্ট (মেহেদিশিল্পী) হিসেবে বেশ নাম করেছেন। আথুব তাঁকে নিয়ে কুয়েত টাইমস-এ একটা প্রতিবেদনও লিখেছেন। স্মার্টফোনে সেই প্রতিবেদন দেখালেন। যোগাযোগ হলো সামিয়ার সঙ্গে, কথা হলো কদিন আগে ঢাকায় ফিরে। 

কদিন পরে ঈদ। তাই সামিয়া হাসানাত এখন ব্যস্ত মেহেদি পরানোয়। ফোনেই বললেন, ‘এই সময়টায় ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ঈদের কদিন আগে তো অনেক বেশি কাজ থাকে।’

মেহেদিতে এক নারীর হাত রাঙিয়ে দিচ্ছেন সামিয়া হাসানাত। ছবি: সংগৃহীত
মেহেদিতে এক নারীর হাত রাঙিয়ে দিচ্ছেন সামিয়া হাসানাত। ছবি: সংগৃহীত

সারা বছরই কুয়েতে নিজের বাসায় কিংবা কোনো আয়োজনে মেহেদির রঙে মেয়েদের হাত রাঙিয়ে দেন সামিয়া। রোজা, ঈদ বা বিয়ের মৌসুমে চাহিদা থাকে বেশি। ঈদের সময় নিজের হাতে মেহেদি পরার এক অভিজ্ঞতা থেকেই সামিয়ার মেহেদিশিল্পী হয়ে ওঠা।

ছোটবেলায় প্রতিবছর ঈদের সময় বাংলাদেশে আসত সামিয়ার পরিবার। ‘আমি কোনো কিছুই আঁকতে পারতাম না। দেশে ঈদের সময় খালা মেহেদি পরিয়ে দিতেন। আমার তখন ১৩ বছর বয়স। সেবার স্কুলে পরীক্ষা থাকায় দেশে যেতে পারলাম না।’ কিন্তু ঈদের সময় তো মেয়ের মেহেদি পরতেই হবে। মা মেহেদি লাগিয়ে দিতে পারেন না। তাই বাবা কুয়েতের এক সেলুনে নিয়ে গেলেন সামিয়াকে। ওখানে খুব ভিড় ছিল। তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ওরা পরের দিন আবার যেতে বলল।

সামিয়ার নকশায় রাঙা হাত
সামিয়ার নকশায় রাঙা হাত

কিশোরী মেয়ের মনটাই ভেঙে গেল। ‘বাসায় এসে কাঁদলাম। মনে একটা জিদ চেপে গেল। ইন্টারনেট থেকে মেহেদি নকশার ছবি দেখে কাগজে আঁকা শুরু করলাম।’ বললেন সামিয়া। কাগজে আঁকলেই তো আর হয় না, মানুষের হাতেও আঁকতে হবে। সেই নিরীক্ষা চলল মায়ের ওপর দিয়ে। তারপর বন্ধুদের হাত। এভাবেই শুরু হলো সামিয়ার মেহেদি পরানো।

বয়স যখন ১৪, কুয়েতে বন্ধুমহলে সামিয়ার মেহেদি নকশার খ্যাতি ছড়াতে লাগল। এক বন্ধু তখন তাঁকে বলেন, ‘তুমি তো ভালো নকশা করো, টাকা নিতে পারো না?’ এভাবে আগে কখনো ভাবেননি সামিয়া। ভারতীয় স্কুলে পড়তেন তখন। বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু—সবাই চান তাঁর কাছে মেহেদি পরতে। ‘একজন তখন আমাকে বললেন, “ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট খোলো।” তখন আমার বয়স ১৫ বছর। আমি ভাবলাম, খুলি। এভাবেই কখন যে ব্যবসা হয়ে গেল, বুঝিনি। মা-বাবা বললেন, “এসব কোরো না, পড়াশোনায় প্রভাব পড়বে।” কিন্তু আমি বিষয়টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। মেহেদির নকশা আঁকলে আমি ভেতরে শক্তি পাই। পড়াশোনাও ভালো হতে থাকল।’ এখন মা-বাবাই সামিয়ার মেহেদিশিল্পের মূল সহযোগী।

মা–বাবার সঙ্গে সামিয়া
মা–বাবার সঙ্গে সামিয়া

ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে নিজের পেজ দিয়েই গ্রাহক পেতে থাকেন সামিয়া হাসানাত। প্রথমে তাঁর এই ব্যবসা উদ্যোগের নাম দেন ‘সামিয়া মেহেদি আর্টিস্ট’, কিন্তু ওখানে মেহেদির চেয়ে হেনা শব্দটা পরিচিত বেশি। তাই এখন নাম দিয়েছেন ‘দি হেনা স্টুডিও বাই সামিয়া হাসানাত’। এ-ও জানালেন, ভবিষ্যতে যখন স্টুডিও খুলবেন, তখন মেহেদি শব্দটাই ব্যবহার করবেন।

২০১৫ সালের শেষ দিকে ১৭ বছর বয়সে প্রথম একটা আয়োজনে ডাক পান সামিয়া। কুয়েত সিটির র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলে একটা সুগন্ধি বাজারজাত করার অনুষ্ঠানে সামিয়াকে ডাকা হয় মেহেদি পরানোর জন্য। ‘তখন গুগলে খুঁজলে আমার নামসহ আরও দু-একজন মেহেদিশিল্পীর নাম আসত। আমার বয়স কম দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত।’ এই অনুষ্ঠানেই কুয়েত টাইমস-এর আথুবের সঙ্গে দেখা হয় সামিয়ার। আথুব এ আলশুয়াইবি বলছিলেন, ‘আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি, একটা বাচ্চা মেয়ে কীভাবে এত সুন্দর নকশা আঁকছে মেহেদি দিয়ে। আর তার মা ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। এই মেয়ে ইউটিউবেও মেহেদির টিউটোরিয়াল প্রকাশ করে।’ ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি কুয়েত টাইমস-এ সামিয়াকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। যার শিরোনাম ছিল ‘ফর দ্য লাভ অব হেনা: ইয়াং আর্টিস্ট ডেভেলপস হার ট্যালেন্ট ইন কুয়েত’।

কুয়েত টাইমস–এ সামিয়াকে নিয়ে প্রতিবেদন
কুয়েত টাইমস–এ সামিয়াকে নিয়ে প্রতিবেদন

গোপালগঞ্জের মেয়ে সামিয়া হাসানাতের জন্ম ১৯৯৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে। বাবা মো. খাইরুল হাসানাত ও মা মিতা পারভীনের একমাত্র সন্তান সামিয়া। ২০০৫ সালে তাঁরা চলে আসেন কুয়েতে। এখানে বেড়ে উঠেছেন সামিয়া। এখন ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক (বিবিএ) করছেন অ্যারাব ওপেন ইউনিভার্সিটিতে।

মেহেদিশিল্পী হিসেবে সামিয়ার ব্যস্ততা রয়েছে ভালোই। বললেন, ‘আয়োজন থাকলে দিনে ১০০ জনের হাতেও মেহেদি পরিয়ে দিই। বিয়ের কনে হলে তাঁদের বাড়ি গিয়ে কাজ করি। আর এমনিতে প্রতিদিন গড়ে চার-পাঁচজনের হাতে মেহেদি পরাই। আমি বাজারের কৃত্রিম মেহেদি ব্যবহার করি না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেহেদি গুঁড়া আনিয়ে নিই। বাকি উপকরণ নিজে তৈরি করি।’

মুঠোফোনের খাপে সামিয়ার করা নকশা
মুঠোফোনের খাপে সামিয়ার করা নকশা

মেহেদি নকশার পাশাপাশি আরেকটা কাজও করেন সামিয়া। তা হলো মোবাইল ফোনের খাপে (কেস) নকশা করে দেন। ‘অ্যাক্রিলিক রং আমরা যেকোনো তলে (সারফেস) ব্যবহার করতে পারি। মোবাইল ফোনের কেস এভাবেই রং করি।’ চাহিদা অনুযায়ী এগুলো অনলাইনেই বিক্রি হয়। এর গ্রাহক বাংলাদেশেও রয়েছে। মেহেদি নকশার বেলায় কুয়েতে সামিয়ার গ্রাহকদের মধ্যে ভারতীয় ও পাকিস্তানিরাই বেশি। ‘কুয়েতি নারীরাও আমার কাছে আসেন, তবে তাঁরা শুধু হাতে মেহেদি পরেন। প্রবাসী বাংলাদেশি কিছু গ্রাহকও আছে।’

মেহেদিশিল্পীদের বেশির ভাগই পশ্চিমা ধাঁচের নকশা করেন। সামিয়া আঁকেন ভারত ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশা। কখনো ফুল, কখনোবা  ময়ূর ফুটে ওঠে সামিয়ার নকশায়। ‘মেহেদিশিল্পীরা সাধারণত মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে ওঠেন, মেকআপ স্টুডিও খোলেন। কিন্তু আমি শুধু মেহেদিশিল্পীই হতে চাই।’ পড়াশোনা শেষ করে নিজের মেহেদি স্টুডিও খুলবেন সামিয়া। আর তা বাংলাদেশে। বললেন, ‘২০২০ সালে বাংলাদেশে ফিরে যাব আমরা, তখন ঢাকায় নিজের স্টুডিও খুলব।’

সেই প্রতীক্ষায় থাকলাম আমরাও। মেহেদির রঙে রাঙা হয়ে উঠুক সামিয়ার ভবিষ্যৎ।