জিতলেও জয়, হারলেও জয়!

>বাংলাদেশের জন্য এবারের ইউনাইটেড এশিয়ান ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল অন্য রকম। এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের ৬২টি দলের মধ্যে লড়াই শেষে ফাইনালে উঠেছিল দুটি দল—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি)। অর্থাৎ হার-জিত যারই হোক, জয় বাংলাদেশের! কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত? ব্যতিক্রম এই লড়াইয়ের খবর জানাচ্ছেন তৌশিকুর রহমান
রানার আপ আইবিএ (সামনে) এবং চ্যাম্পিয়ন আইইউবির শিক্ষার্থীদের দল। ছবি: সুমন ইউসুফ
রানার আপ আইবিএ (সামনে) এবং চ্যাম্পিয়ন আইইউবির শিক্ষার্থীদের দল। ছবি: সুমন ইউসুফ

ছোট ছোট দল হয়ে বসে ছিলেন এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তরুণেরা। সংখ্যায় প্রায় ৩০০। তাঁদের মধ্যে আছেন বিতার্কিক, বিচারক ও অতিথি। ঘটনাস্থল ইন্দোনেশিয়ার বান্ডুংয়ে অবস্থিত হোটেল হলিডে ইন। বলরুমে তখন চাপা উত্তেজনা। কোথাও ফিসফিস, কোথাও চাপা হাসির শব্দ। কিসের অপেক্ষা?

১ জুন হোটেল হলিডে ইনের বলরুমে বসেছিল ইউনাইটেড এশিয়ান ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ (ইউএডিসি) ২০১৮-এর আসর। ‘ওপেন’ ক্যাটাগরির ফাইনালিস্ট দল দুটোর নাম ঘোষণা হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২টি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পাঁচটি দলের মধ্যে দুটি দল ভিন্ন দুই সেমিফাইনালে অংশ নিয়েছে। তাই হলরুমে হাজির বাংলাদেশিদের মধ্যে আগ্রহ একটু বেশি। এই প্রতিযোগিতায় আগে কখনোই ফাইনালের নাগাল পাওয়া যায়নি। ছেলেমেয়েদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সবার মনে একটাই ভাবনা—এবার হবে তো?

দ্বিতীয় সেমিফাইনালের যে দলটি জয়ী হয়েছে, তাদের নাম ঘোষণা করা হলো আগে। ঘোষণা করলেন এই পর্বের চেয়ার ফিলিপাইনের ক্রিশ্চিয়ান মানজানো। তাঁর কথা শেষ না হতেই বলরুমের এক কোনা থেকে শোনা গেল হইহুল্লোড়। সঙ্গে স্লোগান—আইইউবি, আইইউবি, আইইউবি! হ্যাঁ, আইইউবি মানে হলো আমাদের ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। চমক তখনো বাকি। এরপরই এল প্রথম সেমিফাইনালের ফল। সেই সেমিফাইনালের চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সিঙ্গাপুরের শের মে নার যখন ফলাফল ঘোষণা করলেন, একই জটলা থেকে আবারও শোনা গেল হুল্লোড়। এবারের স্লোগান—আইবিএ, আইবিএ, আইবিএ! অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো স্লোগান মিলেমিশে এক হয়ে গেল। আইবিএ কিংবা আইইউবি নয়, এবার স্লোগান উঠল—বাংলাদেশ, বাংলাদেশ! লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেছেন, ফাইনালে জয়-পরাজয় যারই হোক, শিরোপাটা বাংলাদেশের হাতেই থাকছে!

এশিয়ার এই বড় বিতর্কের প্রতিযোগিতার ফাইনাল আয়োজিত হয়েছিল পরদিন। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নের মুকুট পেয়েছে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষার্থীদের দল।

প্রতিযোগিতা শেষে বাংলাদেশের পতাকা হাতে দুই দল। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিযোগিতা শেষে বাংলাদেশের পতাকা হাতে দুই দল। ছবি: সংগৃহীত

আইইউবির চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যরা হলেন আকিব ফারহান হোসেন, মাহমুদুল হাসান ও যোবায়ের আহমেদ। যোবায়ের পড়াশোনা করছেন কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষে, আর মাহমুদুল ও আকিব স্নাতকোত্তর করছেন মাস্টার্স ইন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে। অপর দিকে রানার্সআপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ দলের সদস্যরা হলেন রায়ান ইবতেশাম চৌধুরী, কাজী আশফাকুল হক ও শামসুল নাওয়েদ। তাঁরা সবাই বিবিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

ইউনাইটেড এশিয়ান ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপকে বলা হয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় বিতর্ক প্রতিযোগিতা। ২০১০ সাল থেকে চালু হওয়া এই প্রতিযোগিতা প্রতিবছর এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকদের খুঁজে বের করার একটা ‘প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে কাজ করে। ইন্দোনেশিয়ার বান্ডুংয়ে এবারের আসরের আয়োজক হিসেবে ছিল ব্রডওয়ে এন্টারটেইনমেন্ট গ্রুপ এবং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-বান্ডুং। বাংলাদেশ থেকে মোট পাঁচটি দল অংশ নেয় এবারের আসরে। ফাইনালিস্ট আইইউবি এবং আইবিএ ছাড়াও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএরই আরও একটি দলের অংশগ্রহণ ছিল ২৭ মে থেকে ২ জুন মোট ছয় দিনব্যাপী হওয়া এই প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার বেশ কয়েটি দেশ থেকে মোট ৬২ দল অংশ নিয়েছিল এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হওয়ার লক্ষ্যে।

দেশে ফেরার পর কথা হলো ফাইনালে অংশ নেওয়া দুই দলের সঙ্গে। জানা গেল, ফাইনালে পৌঁছানোর রাস্তাটা সহজ ছিল না একেবারেই। আইবিএর রায়ান যেমন বলছিলেন, ‘প্রথম ধাপ বা প্রিলিমিনারি স্টেজে “থ্রি অন থ্রি” এশিয়ান পার্লামেন্টারি ফরম্যাটে বিতর্ক হয় মোট ৮ রাউন্ড। তিনজন বক্তা সাত মিনিট করে এই ফরম্যাটে বক্তব্য দেওয়ার সময় পান। এই ৮ রাউন্ড বিতর্ক শেষে নকআউট পর্বের জন্য নির্বাচন করা হয় সেরা ১৬ দলকে।’ সেরা ১৬-তেও ছিল বাংলাদেশিদের জয়জয়কার। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অপর দলটিও জায়গা করে নিয়েছিল সেরা ১৬-তে। নকআউট পর্বে এসে সেরা আটে জায়গা করে নেয় আইইউবি ও আইবিএর দল দুটো। সেমিফাইনালে আইইউবি মুখোমুখি হয়েছিল মালয়েশিয়ার টেইলর ইউনিভার্সিটির এবং ফিলিপাইনের ডে লা সেল ইউনিভার্সিটির মুখোমুখি হয়েছিল আইবিএ।

আইবিএর শামসুল নাওয়েদ জানালেন, ‘গতবারও আমরা একই দল অংশ নিয়ে সেরা ১৬-তে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। আর তাই এবার আমাদের লক্ষ্য ছিল অন্তত ১৬-র মধ্যে জায়গা করে নেওয়া।’ তাঁর সঙ্গে কাজী আশফাকুল যোগ করলেন, ‘ইউএডিসিতে এত দিন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল ২০১৫ ও ২০১৭-এর আসরে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত উঠতে পারা। সেখানে এবারে বাংলাদেশের দুই-দুইটা দলের একসঙ্গে সেমিফাইনাল ছাড়িয়ে ফাইনালে ওঠা, চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ খেতাব ভাগাভাগি করে নেওয়া; অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা।’

চ্যাম্পিয়ন দল আইইউবির অভিজ্ঞতা আরও চমকপ্রদ। দলের তিন তরুণ যোবায়ের, আকিব ও মাহমুদুল জানালেন, ‘এবারই প্রথমবারের মতো আমরা অংশ নিই ইউএডিসি বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। আর সেখানে অংশ নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দলকে হারিয়ে দেওয়া এবং সবশেষে একেবারে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অসাধারণ এক প্রাপ্তি।’

বাংলাদেশে বিতার্কিকেরা একটা পরিবারের মতো। ফাইনালে অংশ নেওয়া যে দুটো দলের কথা আমরা বলছি, এরা কিন্তু সবাই আগে থেকেই একে অপরের পরিচিত। স্কুল-কলেজে কেউ কেউ কখনো একদল হয়ে লড়েছেন, কখনো একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। জয়-পরাজয় ছাপিয়ে দিন শেষে বিতর্কের মঞ্চ কাটানো সময়টা তাঁরা উপভোগ করেন।

জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বিচারকদের মধ্যে দুজন ‘ব্রেকিং জাজ’-এর খেতাব পেয়েছেন এবারের আসরে। তাঁরা হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. শাদমান করিম এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসিফ মুজতবা। প্রতিযোগিতার বাইরেও এই ছয় দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের বান্ডুংয়ের বিভিন্ন পর্যটন এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হয়। বিচারকদের জন্য ছিল আলাদা সম্মেলন।