গাহি ফুটবলের গান

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

আমার সংসারে যদি কোনো অশান্তি লাগে, তবে তা এই ফুটবলই লাগাবে। না, তার কারণ এই না যে আমরা দুজন বিশ্বকাপে দুই দল সমর্থন করি। খেলাধুলার ব্যাপারে তিশার আগ্রহ হিমাংকেরও নিচে। কতটা নিচে সেটা বোঝা যাবে নিচের ঘটনা থেকে। গত বিশ্বকাপের সময় আমি তিশাকে বললাম, ‘প্রথম আলো থেকে আসতেছে। আমার আর তোমার ছবি তুলবে, বিশ্বকাপের জার্সি পরিয়ে। তুমি কি আর্জেন্টিনার জার্সি পরবা? আমি পরব ব্রাজিল।’
‘কিন্তু আমি তো মনে হয় ব্রাজিল সাপোর্ট করতাম। দাঁড়াও, আমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিই, আমি কোন দল সাপোর্ট করতাম। অবশ্য আমার ব্রাজিলই কি আর্জেন্টিনাই কি। বরং আমরা দুইজন দুইটা পরে মারামারি থামানোর আহ্বান জানাই চলো।’
এহেন সহনশীল এবং অনাগ্রহী ফুটবল দর্শক সে। প্রথমে যে অশান্তির কথা বলেছিলাম, সেটা তাহলে কেন লাগবে? সেটা লাগবে রাতের বেলা লাইভ ফুটবলের অত্যাচারে। বছরে জুলাই আর আগস্ট—এই দুইটা মাস সে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। বাকি ১০ মাস টেলিভিশন মিউট থাকলেও মাঝেমধ্যেই মাঝরাতে মদীয় ‘গোল’ চিৎকারে বেচারার ঘুম ভেঙে যায়। তখন আমি চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়ানোর কসরত করে আমার অপরাধবোধ তাড়ানোর চেষ্টা করি।
তো কী আছে ফুটবলে? উত্তরে আমি তো বলব, কী নাই ফুটবলে? সমরকৌশল, মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, থ্রিল, রাজনীতি, কবিতা, চিত্রনাট্য, এডিটিং রিদম, পেসিং, দর্শন—কী নাই! যখন তাবৎ বার্সেলোনার সমর্থক ২০১৭-তে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে লিভারপুল ফ্যান হয়ে যায় তখন কি সেখানে রাজনীতি থাকে না? হোসে মরিনহো যখন লন্ডনে নাজেল হয়েই নিজেকে ‘স্পেশাল ওয়ান’ দাবি করেন, তখন কি সেটা যুদ্ধের ময়দানে এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক স্তরের আমদানি করে নাই? কখনো কখনো দেখি একটা দল প্রথম দিকে নিজেদের অর্ধে অলস বসে থাকে আর বিপক্ষ দলকে লাফাতে-ঝাঁপাতে দেয়। তারপর তারা ক্লান্ত হয়ে এলেই শুরু করে উপর্যুপরি আক্রমণ, এটা কি সুন জু-র দ্য আর্ট অব ওয়ার-এর চেয়ে কম কিছু? কখনো যে বিপক্ষ দলকে আক্রমণের লোভ দেখিয়ে ওপরে তুলে এনে নির্দয় কাউন্টার অ্যাটাকে গোল দেওয়া হয়, সেটা তো ক্ল্যাসিক ঢাল-তলোয়ার যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনকে ফাঁদে ফেলার আদি কৌশলই। কখনো কখনো যে খেলার গতি টেনে শ্লথ করা হয়, আবার কখনো উসকে দেওয়া হয় গতি, সেটাই তো সিনেমার পেসিং, নাকি? ২০০৫-এ কনফেডারেশন কাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ব্রাজিল যখন ২১ পাসে গোল কমপ্লিট করে তখন কি কবিতা রচিত হয় না? ২২ জুন ’৮৬-তে ম্যারাডোনা যখন পাঁচজনকে কাটিয়ে এক দুর্দান্ত গোল করলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, তখন এর চেয়ে থ্রিলিং সিনেমা আর কী হতে পারে?

ম্যারাডোনার ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র আগ মুহূর্ত
ম্যারাডোনার ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র আগ মুহূর্ত

তো এই মহিমান্বিত ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর আবার হাজির আমাদের সামনে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের সাজে সেজেছে। আমি জানি না পৃথিবীতে ‘এমন দেশটি’ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, যেখানে গোটা দেশ সাজে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা জার্মানির পতাকায়। ছোটবেলার একটা প্রচলিত কথা, ‘ভাত পায় না চা খায়, সাইকেল নিয়া টয়লেটে যায়’! সেদিন দেখলাম একজন জায়গা জমি বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে জার্মানির পতাকা বানিয়েছেন। তো এই পাগলামি আপনি আর কোথায় পাবেন? আমরা এমনই ‘সম্পূর্ণ রঙিন! টেলিভিশন ছবি বানানোর পর যখন ইউরোপিয়ান সেলস এজেন্টদের দেখাচ্ছি, তখন একজন খুব আগ্রহী হলেন। কিন্তু কিছু বিষয়ে তাঁর খুঁতখুঁত আছে, সেটাও আমাকে জানাতে ভুললেন না। বুঝতে পারলাম, সেগুলো সংশোধন না করলে তাঁর আগ্রহটা আর না-ও থাকতে পারে। খুঁতখুঁতির প্রধান জায়গাটা হলো, ছবিতে সবাই এত কান্নাকাটি করে কেন? ছেলে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। রাতের বেলাতেই সে আবার বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে কেন? এই রকম আরও অনেক কান্নার দৃশ্য মেনশন করলেন তিনি। আমি কয়েক দিন সময় নিয়ে তাঁকে বললাম, এগুলো সংশোধন করলে তো আর আমরা ‘আমরা’ থাকব না। আমরা এমনই রঙিন। কাঁদি বেশি, হাসি বেশি, খাই বেশি, আমরা বেশি বেশি।
বাংলাদেশ এখন ফুটবলের রঙে রঙিন। রঙিন আমারও মন। প্রায় প্রতিদিনই খেলার সূচি দেখছি, প্রেডিক্ট করছি কী হতে পারে, কোন দল সারপ্রাইজ প্যাকেজ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এসব। ব্রাজিল সমর্থক বলে বলছি না, আমার মনে হচ্ছে, এবার বিশ্বকাপ জেতার সবচেয়ে বড় দাবিদার ব্রাজিল, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স। আর্জেন্টিনাকেও আমি এই কাতারে রাখতাম, যদি দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্স বা কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের সঙ্গে খেলা না পড়ত। দুই দলের খেলোয়াড়দের প্রোফাইল দেখলে আর্জেন্টিনার পক্ষে প্রেডিক্ট করা মুশকিল। কিন্তু খেলাটা তো মাঠে হবে, প্রোফাইলে হবে না। ফলে নির্দিষ্ট দিনে উল্টে যেতে পারে যেকোনো হিসাব। তাই আমি আর্জেন্টিনাকে ফেবারিট ফাইভে রাখতে চাই।

সালাহ সুস্থ হলে বা ফর্মে থাকলে অঘটন ঘটানোর ক্ষমতা আছে মিশরেরও
সালাহ সুস্থ হলে বা ফর্মে থাকলে অঘটন ঘটানোর ক্ষমতা আছে মিশরেরও

এবার একটু এশিয়া আর আফ্রিকা নিয়ে কথা বলতে চাই। এশিয়ার সম্ভাবনা বরাবরের মতোই ক্ষীণ। আর আফ্রিকা সব সময়ই চমকে দিতে পারে। মনে আছে রজার মিলার ক্যামেরুনের কথা? কিন্তু এবার কি এমন কোনো আফ্রিকান দল আছে, যারা সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়ে লিখতে পারে নতুন ইতিহাস? বলা মুশকিল। তবে আমি নাইজেরিয়া আর সেনেগালের দিকে তাকিয়ে থাকব। মোহাম্মদ সালাহ সুস্থ হলে বা ফর্মে থাকলে অঘটন ঘটানোর ক্ষমতা তাঁদেরও আছে। দেখা যাক, কতদূর যায় আফ্রিকা।
এর বাইরে দুইটা দল আছে, যারা সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা রাখে, এমনকি কাপ জিতলেও অবাক হবেন না। বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ড। কিন্তু তার আগে তাদের বিশ্বাস করতে হবে যে তারা কাপ জিততে পারে। বলা হয়, ইতিহাস খেলে না, খেলে খেলোয়াড়েরা। আমি বলি, ইতিহাসও খেলে। ইতিহাস খেলে মনোবল হয়ে। যাদের জেতার ইতিহাস যত সমৃদ্ধ, তাদের জেতায় বিশ্বাসও ততটাই প্রখর। তাই বলে কি ইতিহাস তৈরি হবে কেবল পুরোনো হাতেই? না, তীব্র আকাঙ্ক্ষাই ইতিহাসের বাধা ডিঙাতে শক্তি দেয়! সেই শক্তি কি বেলজিয়াম দেখাতে পারবে? বা ইংল্যান্ড? আমরা জানি না, তবে জানব আগামী এক মাসে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: চলচ্চিত্র নির্মাতা