মাদারীপুরের সাহসী মিরাজ

মানুষের প্রতি সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে কোনো ব্যক্তির অনন্য সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ফারাজ হোসেন সাহসিকতা’ পুরস্কার দেওয়া হয়। ফারাজ আইয়াজ হোসেন স্মরণে এই পুরস্কার প্রবর্তন করেছে পেপসিকো গ্লোবাল। পেপসিকো ২০ বছর পুরস্কারটি প্রদান করবে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্বীকৃতি সনদের পাশাপাশি পান ১০ হাজার মার্কিন ডলার। অসীম সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে মিরাজ সরদার এবং ২০১৭ সালে খন্দকার আবু তালহা (মরণোত্তর) পুরস্কারটি পেয়েছেন।

পুরস্কার পাওয়ার পর নিজ কর্মস্থলে সহকর্মীদের সঙ্গে মিরাজ (বাঁ থেকে তৃতীয়)
পুরস্কার পাওয়ার পর নিজ কর্মস্থলে সহকর্মীদের সঙ্গে মিরাজ (বাঁ থেকে তৃতীয়)

মিরাজ সরদারের সাহসী কাজ ছিল কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী জঙ্গিকে হাতেনাতে ধরে ফেলা। ধরে ফেলে তিনি ওই জঙ্গিকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন আর রিপন চক্রবর্তীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আর এই সাহসী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে ‘ফারাজ হোসেন সাহসিকতা’ পুরস্কার পান মিরাজ।

গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেন নামে পেপসিকো গ্লোবালের উদ্যোগে ২০১৬ সালে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

মাদারীপুরে থাকেন মিরাজ। স্থানীয় লোকজনের কাছে তিনি একজন নায়ক। ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার পাওয়ায় মিরাজের জীবনও বদলে গেছে। যা তিনিও ভাবেননি। জানালেন, নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ অতিথি হিসেবে মিরাজকে আমন্ত্রণ জানায়। এতে তিনি নিজেও ভালো কাজ করার উৎসাহ পান আর অন্যরাও মিরাজকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়।

মিরাজ সরদারের ছোটবেলা কেটেছে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। বাবা দুলাল সরদারের চাকরির কারণে সাত বছর বয়সে মাদারীপুর শহরে চলে আসেন মিরাজ। মিরাজের দুই ভাই ও দুই বোন। সবার বড় মিরাজ। তাই দায়দায়িত্ব বেশি। পরিবারের সচ্ছলতা ছিল না। ১৫ বছর বয়স থেকেই কাজে নেমে পড়তে হয়েছিল মিরাজকে। স্বল্প মূলধন দিয়ে মাদারীপুর শহরের শকুনি লেকের পাড়ে দিয়েছিলেন একটি চায়ের দোকান। চায়ের দোকানে চা বিক্রি করে যা আয় হতো তা দিতেন সংসারে। এরই মধ্যে চালিয়ে গেছেন নিজের পড়ালেখা। আর্থিক সংকটের কারণে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। তবে ছোট ভাইবোনদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন। পরিবারের এক বড় ভরসার জায়গা ছিলেন মিরাজ। প্রায় দেড় যুগ আগে মিরাজ সরদার চাকরি পান মাদারীপুরের সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজে বেসরকারি পদমর্যাদায় অফিস সহায়ক পদে। বর্তমানে তিনি একই পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও মিরাজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন। এখন তিনি চান দরিদ্র মানুষের সার্বিক কল্যাণে একটি সংগঠন খুলতে। মিরাজ বলেন, ‘আমি ধর্মে বিশ্বাস করি, কিন্তু কোনো অধর্মকে নয়। ২০১৬ সালের কথা আমার এখনো মনে পড়ে। এক জঙ্গিগোষ্ঠী আমাদের কলেজের সাবেক শিক্ষক রিপন স্যারের ওপর হামলা করে। আমি হামলাকারীকে ধরেছি। আমি শুধু মনে করেছি, স্যারকে বাঁচাতে হবে। আর ঘটনা যে ঘটিয়েছে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।’

সেদিন কোনো কিছুর আশা করেননি মিরাজ সরদার। তিনি বললেন, ‘স্বাধীন দেশে একজন নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছি। আমার জীবনে এই সাহসিকতাটুকুই সব সুখ এনে দিয়েছে। তাই আমি যত দিন বাঁচব, দেশের জন্য কাজ করব।’

মিরাজ গরিব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। সরকারি হাসপাতালে গিয়ে অসহায় রোগীদের সহযোগিতা করেন। ওষুধের জোগান দেওয়ার চেষ্টা করেন। ঝরে পড়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণও দেন।

স্ত্রী এবং ১২ বছর বয়সের এক ছেলেকে নিয়ে মিরাজের পরিবার। মাদারীপুরে ‘বিশ্লেষণ সামাজিক আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন মিরাজ সরদার। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক জহিরুল ইসলাম খান বলেন, ‘মিরাজ শুধু মাদারীপুরবাসীর গর্ব নন, দেশের গর্ব। ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার পাওয়ার পর সামাজিক কাজে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়েছেন মিরাজ। মিরাজকে দেখে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে।’