ফুটবলের মহারণে

ফ্যান ফেস্টে দেখা মিলল এই তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের। ছবি: লেখক
ফ্যান ফেস্টে দেখা মিলল এই তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের। ছবি: লেখক

লাখ লাখ ফুটবলপ্রেমীর পদভারে রাশিয়া এখন প্রকম্পিত। ৩২ দেশের ‘ফুটবল মহাযুদ্ধ’ উপভোগ করতে পুতিনের রাশিয়া এখন উৎসবের বেলাভূমি। দেশটির ১১টি শহরে দেখা মিলছে নানা বর্ণের নানা সংস্কৃতির মানুষ। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, আস্ট্রেলিয়া, এশিয়া—সব মহাদেশ থেকেই ফুটবলপ্রেমীরা তরি ভিড়িয়েছেন এখানে। আনন্দের বন্যা আজ সবখানে। বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ সবকিছু সাজানো হয়েছে বিশ্বকাপের সাজে। সবখানে পর্যটকদের সরব উপস্থিতি।

 গত ২২ জুন পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে ঢোকার আগে কথা হয় এলিয়াস দি সুজার সঙ্গে। ব্রাজিলের এই কট্টর সমর্থক রাশিয়া এসেছেন, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তাঁর প্রিয় সাইকেল। তিনি নিশ্চিত, এবার ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হবে।

যা হোক, সেন্ট পিটার্সবার্গে অ্যারনোভস্কি প্রস্পেক্টে চলছিল ফিফা ফ্যান ফেস্ট। লাল পতাকায় ছেয়ে গেছে অলিগলি রাজপথ। ২৪ জুন দুপুর, রাশিয়া-উরুগুয়ে ম্যাচ শুরুর আগের মুহূর্ত। গালে রাশিয়ার পতাকার রং, আর হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ফ্যান ফেস্টে এসেছেন দারিয়া ও পাভেল। পাভেল ও দারিয়া পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাস করেছেন। পাভেল বলেন, ‘একসঙ্গে এত দেশের মানুষ সাধারণত রাশিয়ায় আসে না। এত মানুষের আতিথেয়তা দিতে পেরে আমরা সত্যিই আনন্দিত।’ দল নিয়ে প্রত্যাশা কী, জানতে চাইলে দারিয়া বলেন, ‘সেমিফাইনালে গেলেই আমরা খুশি।’ পাভেলের প্রত্যাশা, ‘বড়জোর কোয়ার্টার ফাইনাল। আমাদের চেয়ে অনেক ভালো দল এই বিশ্বকাপে রয়েছে।’

ব্রাজিল থেকে এসেছেন দলকে সমর্থন জানাতে
ব্রাজিল থেকে এসেছেন দলকে সমর্থন জানাতে

অ্যালেক্সি বাংলাদেশকে চেনে

আমরা রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছি। বিশ্বকাপের টি-শার্ট পরা এক ভদ্রলোক মস্কো রেলস্টেশনে এগিয়ে এসে সুন্দর ইংরেজিতে জানতে চাইল, ‘আমি কি কোনো কাজে আসতে পারি?’

-ট্রেনের কেবিনটা খুঁজে দিলে খুব ভালো হয়।

পরিচয়ে জানা হলো তার নাম অ্যালেক্সি। আইটি প্রকৌশলী। অ্যালেক্সি ফুটবলপ্রেমী। তাকে পেয়ে একটা স্বস্তির পরশ পেলাম।

-প্রথম দুই ম্যাচে তো রাশিয়া খুব ভালো খেলেছে। কী ফল প্রত্যাশা করো রাশিয়ার কাছে? অ্যালেক্সির উত্তর, ‘দ্বিতীয় রাউন্ডের বাধা পেরোনো কঠিন হবে। এই ম্যাচে জিততে পারলে ফাইনাল খেলা অসম্ভব কিছু না।’

অ্যালেক্সি ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসেবে ইংরেজি শিখেছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তাই আড্ডা দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম, বাংলাদেশকে চেনো কি না? অ্যালেক্সি বলল, ‘চিনি। বাংলাদেশ সেক্যুলার দেশ। কিন্তু মুসলিম মেজরিটি।’

-সেক্যুলার কীভাবে জানো?

আর্জেন্টাইন দুই সমর্থকের সঙ্গে লেখক
আর্জেন্টাইন দুই সমর্থকের সঙ্গে লেখক

অ্যালেক্সির উত্তর, ‘সেক্যুলার এ জন্যই তারা তো মৌলবাদী পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হয়েছে। এটা আমি জেনেছি গ্রান্ডপার কাছে।’

-সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? অ্যালেক্সির উত্তর, ‘বাংলাদেশের ফুটবল আমার দেখার সুযোগ হয়নি। নিশ্চয় তারা ভালো খেলে। শুনেছি, বাংলাদেশে পরমাণু কেন্দ্র করে দিচ্ছে রুশ সরকার। রাশিয়া বাংলাদেশের বন্ধু দেশ। (রুশরা ইংরেজি বলে না। ১০০ জনেও একজন ইংরেজি জানা মানুষ খুঁজে পাওয়া পাওয়া যায় না। কেউ কেউ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখে।)।

 ২৪ জুন ফ্যান আইডি সেন্টারে দেখা মেলে এক আর্জেন্টাইন দম্পতির। ষাটোর্ধ্ব এই দম্পতি দলকে সমর্থন জানাতে এসেছেন আর্জেন্টিনা থেকে। যেকোনো প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বলে চলেছেন, ‘ম্যারাডোনা হচ্ছেন সত্যিকারের গ্রেট ফুটবলার, কারণ তিনি আমাদের বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন।’

-আর মেসি? ‘মেসি যে গ্রেট তার প্রমাণ আমরা এবার পাইনি।’ বলছিলেন তাঁরা।

ফ্যান ফেস্ট যেন আনন্দনগর
ফ্যান ফেস্ট যেন আনন্দনগর

বহু ভাষাভাষীর এই বিশ্বকাপ সফল করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। স্বেচ্ছাসেবীরা বেশির ভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অবশ্য এই তালিকায় সদ্য স্নাতকরাও রয়েছেন। রাশিয়ায় সবখানে সবকিছু শুধু রুশ ভাষায় লেখা। এয়ারপোর্ট বা রেলস্টেশনে ইংরেজি বর্ণমালা থাকলেও তা খুব সীমিত পর্যায়ে। তাই স্বেচ্ছাসেবকদের দোভাষীর কাজ করে সহায়তা দিতে হচ্ছে।

মস্কো রেলস্টেশনে কথা হয় মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আরিনার সঙ্গে। আরিনা বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবীরা ইংরেজি ছাড়াও স্প্যানিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, জার্মানসহ সব ভাষায় সহায়তা দিচ্ছে। আমরা স্বেচ্ছাসেবীরা বিশ্বকাপের মতো এত বড় আয়োজনের অংশ হতে পেতে গর্বিত।’

ফুটবলের এই মহারণ ভাঙবে ১৫ জুলাই মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে। সেদিনই যে ফাইনাল যুদ্ধ হবে!