কুইজ জিতে বিশ্বকাপ দেখা

সারানস্কের মোরদোভিয়া অ্যারেনা স্টেডিয়ামের সামনে হায়দার আলী ও আদিব তানভীর। ছবি: জাবেদ সুলতান
সারানস্কের মোরদোভিয়া অ্যারেনা স্টেডিয়ামের সামনে হায়দার আলী ও আদিব তানভীর। ছবি: জাবেদ সুলতান

২০১৮ বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে প্রথম আলোর কুইজ বিজয়ী হয়ে রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলেন হায়দার আলী ও আদিব তানভীর। গ্রুপপর্বের দুটি ম্যাচ তাঁরা উপভোগ করেছেন গ্যালারিতে বসে। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা থাকছে এই প্রতিবেদনে।

একে তো অপরিচিত, তার ওপর সমবয়সীও নন। এমন দুজন মানুষ একসঙ্গে ঘুরে এসেছেন রাশিয়া। ভ্রমণটা কেমন হলো! কথাটা পাড়তেই আদিব তানভীর বললেন, ‘হায়দার আংকেল ছিলেন অভিভাবকের মতো। এটা বরং পুরো ভ্রমণে সহায়তা করেছে।’ আদিবের কথা শুনে হায়দার আলীর মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ‘আদিব বেশ বন্ধুবৎসল মানুষ। সবার সঙ্গে মিশতে পারে। দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণে ও যে কত বন্ধু বানিয়ে ফেলল। আমি তো অনেকটা সময় ঘুমিয়েই পার করে দিয়েছি।’ তাঁর হাসিমুখ দেখে মনে হলো, সন্তানসম একজনের সঙ্গে ঘোরাটাকে তিনিও উপভোগ করেছেন।

আদিব তানভীর উচ্চমাধ্যমিক শেষে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঢাকার ফার্মগেটে তাঁদের বাসা। হায়দার আলীও ঢাকাতেই থাকেন। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) তিনি। বিশ্বকাপ উপলক্ষে প্রথম আলোর ‘যে জানে, সে ওড়ে’ কুইজে বিজয়ী হয়ে ঘুরে এলেন রাশিয়া। শুধু কি ঘোরা?

ওই যে নিচ থেকে গুনে গুনে পাঁচ নম্বর সারিতে বসার সুযোগ আর চোখের সামনে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দেখা—আদিব তানভীরের কাছে সে সময়টা এখনো অবিশ্বাস্য ঠেকে। যেমন হায়দার আলীর স্বপ্নকেও হার মানিয়েছে গ্যালারিতে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখতে পাওয়া। এমন আরও অনেক অবিশ্বাস্য মুহূর্তের গল্পই দুজনে শোনাচ্ছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে।

মাঠে চলছিল ইরান–পর্তুগাল লড়াই
মাঠে চলছিল ইরান–পর্তুগাল লড়াই

যে অবিশ্বাস্য গল্পের শুরুটা হয়েছে কুইজে প্রথম পুরস্কার জেতার পর। হায়দার আলী বলছিলেন, ‘কুইজে জিতে কেউ কেউ ছোটখাটো পুরস্কার পান, এটা জানা ছিল। কিন্তু বিদেশ ভ্রমণের সুযোগও আয়োজকেরা সত্যি সত্যি দেয়, তা নিজে না পেলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না।’

আদিব তানভীরের কাছেও ব্যাপারটা ঠিক এমনই। কুইজের প্রথম পুরস্কার জেতার খবর জেনে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। বন্ধুরা তখন সংশয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন, ‘সত্যিই যাচ্ছিস তো?’ সেই সংশয়ের ইতি টেনে ২০ থেকে ২৮ জুন তাঁরা ঘুরে এসেছেন রাশিয়া।

রাশিয়ায় তাঁরা থেকেছেন রাজধানী মস্কোতে। এই শহর থেকেই সেন্ট পিটার্সবার্গে ব্রাজিল-কোস্টারিকা ম্যাচ, সারানস্কে পর্তুগাল-ইরান ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন। বিমান আর রেল ভ্রমণের সেই মুহূর্তগুলো তাঁদের স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ে এখনো। কড়া নাড়বেই তো, দুটি ম্যাচে যাওয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে শ্বাসরুদ্ধকর স্মৃতি।

চলতে চলতে বন্ধুত্ব
চলতে চলতে বন্ধুত্ব

হাতছাড়া উড়োজাহাজ

উড়োজাহাজের সময় ছিল ভোর সাড়ে ৫টায়। টিকিট আগেভাগেই কেটে রাখা ছিল। ব্রাজিল-কোস্টারিকা ম্যাচ। দুজনের মধ্যেই তাই চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। ভাবলেন, হাতে সময় নিয়েই তাঁরা বেরিয়ে পড়বেন। কিন্তু বিপত্তি বাধালেন বাসার মালিক। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় মস্কোতে হোটেল বলতে এমন ব্যক্তিমালিকানা বাড়িই ভরসা। রাতে বাসার মালিক আগ বাড়িয়ে বলে রেখেছেন, বিদায়ের সময় তিনিই গাড়ি ঠিক করে দেবেন। সাহায্য যেহেতু করতে চাচ্ছেন, তাই ফোন করে তাঁকে বলা হয়েছিল। তিনি কী বুঝেছিলেন কে জানে। তবে আধঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও গাড়ি এল না। তাঁকে আবার ফোন করে বলবেন বিষয়টি!

কোনো মানে হয় না। বাধ্য হয়ে নিজেই গাড়ির খোঁজ করলেন আদিব। মুহূর্তেই গাড়ি এল। দুজনে উঠে চলে গেলেন বিমানবন্দরে। কিন্তু প্রবেশমুখেই দুজনকে থামানো হলো। জানানো হলো, দেরি করে ফেলেছেন তাঁরা। হায়দার আলী বললেন, ‘তখনো স্ক্রিনে দেখতে পারছিলাম, আমাদের প্রবেশের সময় আছে। কিন্তু তাঁরা আটকালেন। আমরা বোঝাতে চেষ্টা করলাম সমস্যাটা। কিন্তু তাঁরা কিছুই বুঝতে চাইলেন না।’

রাশিয়ায় এসেছেন খেলা দেখতে। সেটাই যদি না হয়, তাহলে আর এসবের মানে কী! বাধ্য হয়ে গেলেন তথ্যকেন্দ্রে। ফিফার স্বেচ্ছাসেবকেরা আন্তরিকতার সঙ্গে সমস্যাটা শুনলেন। সহায়তাও করলেন। তাঁরা পরামর্শ দিলেন অন্য বিমানবন্দরে যাওয়ার। তিনিই টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিলেন। সেখানে পৌঁছাতেও গলদঘর্ম অবস্থা হলো। বাড়তি অর্থ আর ধকল সয়ে এভাবেই সেন্ট পিটার্সবার্গের বিমানে উঠতে হয়েছিল দুজনের। অবশ্য নেইমার-কুতিনহোদের দেখার পর পথের সে ধকল কেটে গিয়েছিল নিমেষেই।

এবারের বিশ্বকাপের মাসকট ‘জাবিভকা’র পাশে আদিব
এবারের বিশ্বকাপের মাসকট ‘জাবিভকা’র পাশে আদিব


টিকিট ঢাকায়, তাঁরা মস্কোয়

ঢাকাতেই হাতে পাওয়ার কথা পর্তুগাল-ইরান ম্যাচের টিকিট। এসেওছিল। কিন্তু তত দিনে ঈদের ছুটি হয়েছে। তাই কুরিয়ার কর্তৃপক্ষ জানাল, টিকিটগুলো রাশিয়ায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়ায় পৌঁছে টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা গেল, ঢাকাতেই রয়ে গেছে সেগুলো। এখন কী হবে? অত চট করে উত্তর মেলেনি। কুরিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন প্রথম আলোর ব্র্যান্ড ব্যবস্থাপক জাবেদ সুলতান। তিনিও তখন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে। কুরিয়ার কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করল। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করলেই তো আর সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। নানা ঘাট ঘুরে ঢাকায় কুরিয়ার থেকে টিকিট সংগ্রহ করা হলো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে, সেদিনই রাশিয়ায় যাচ্ছিলেন পরিচিত একজন। তাঁর হাতেই দেওয়া হলো টিকিট। তিনি রাশিয়ায় পৌঁছালেন ঠিক ম্যাচের আগের দিন। জাবেদ সুলতান ১০ ঘণ্টা ভ্রমণ করে টিকিট সংগ্রহ করলেন। সেই টিকিট নিয়ে তিনি ছুটলেন সারানস্কের মোরদোভিয়া অ্যারেনা স্টেডিয়ামে। ম্যাচ শুরুর ঠিক মিনিট পাঁচেক আগে পৌঁছালেন। একসঙ্গে দেখলেন ইরান-পর্তুগাল ম্যাচ। আদিব বললেন, ‘ঘটনাগুলো তখন খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এখন বেশ রোমাঞ্চকর মনে হয়। আসলে এসবই মনে থাকবে আজীবন।’

সেন্ট পিটার্সবার্গে হায়দার আলী
সেন্ট পিটার্সবার্গে হায়দার আলী

যে জানে সে ওড়ে

গত এপ্রিল মাসে ‘যে জানে, সে ওড়ে’ কুইজ প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করেছিল প্রথম আলো। কুইজের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল পুরস্কার। প্রতিদিন অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে একজনকে দেওয়া হতো রাশিয়া বিশ্বকাপের আনুষ্ঠানিক বল ‘অ্যাডিডাস টেলেস্টা-১৮’। ৩০টি প্রশ্ন নিয়ে ১৫ দিন ধরে চলা প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ উত্তরদাতাদের মধ্য থেকে ১০ জন পেয়েছেন পাঁচতারকা হোটেলে রাতের খাবারসহ ফাইনাল খেলা দেখার সুযোগ। দুজন মেগা পুরস্কার। এই দুজনই হলেন আদিব তানভীর ও হায়দার আলী।