ফের দেখা হবে প্রিয় বাংলাদেশ

পয়লা বৈশাখে সেজেছিলেন বাঙালি সাজে
পয়লা বৈশাখে সেজেছিলেন বাঙালি সাজে
>ডেনিশ তরুণী মিনা ফ্লাইভহোম টোডে! ডেনমার্ক রেডক্রসের তরুণ নেতা হিসেবে আড়াই মাসের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে এ দেশের প্রকৃতি ও মানুষ হৃদয় কেড়েছে তাঁর। দেশে ফিরে গেছেন ২৫ মে। এক মাস পরও বাংলাদেশ তাঁর স্মৃতিতে অমলিন। লিখেছেন স্মৃতিকথা।

নিজের দেশ ডেনমার্কে ফিরেছি এক মাস হলো। কিন্তু বাংলাদেশ যেন এখনো আমার স্মৃতিতে জীবন্ত। আচমকাই নিজেকে আবিষ্কার করি কক্সবাজার, সিলেট কিংবা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলোয়। কখনো আনমনে হারিয়ে যাই সুন্দরবন আর বান্দরবানের বিস্ময়-জাগানিয়া জায়গাগুলোয়।

২১ বছরের জীবনে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, তা অনেক। আমি যেমন ঘুরে বেড়িয়েছি আফ্রিকার ছিমছাম কোনো এক গ্রামে; সেখানে রান্না করেছি কাঠের আগুনে, তেমনি ডেনমার্কের কোনো এক শরণার্থী শিবিরে কাজ করতে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছি, আবার জাপানে গিয়ে ধান চাষও করেছি!

আমার কাছে এসবই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া এই আমি হলফ করে বলতে পারি, এখন পর্যন্ত যেসব দেশে গিয়েছি, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেশটি হলো—বাংলাদেশ।

সীমাহীন দারিদ্র্য যেমন আছে; ঠিক তেমনি আছে অতুল ঐশ্বর্য। বিষাক্ত দূষণে গুমোট বাতাস আছে; আবার আছে বৃষ্টিভেজা মাতাল হাওয়া। সততার মহৎ দৃষ্টান্ত যেমন আছে; আবার আছে অসততার নিকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে এসবই সমান্তরালে চলে। যেন মনে হয় কোনো এক শিল্পী খুব যত্ন করে নিজের সব রং দিয়ে আঁকিয়েছেন দেশের মানুষের বিভিন্নতার রংধনু।

বান্দরবানে ঘুরতে গিয়েছিলেন মিনা ফ্লাইভহোম। ছবি: সংগৃহীত
বান্দরবানে ঘুরতে গিয়েছিলেন মিনা ফ্লাইভহোম। ছবি: সংগৃহীত

এ দেশে প্রতিদিন আমি বিচিত্র মানুষের মুখোমুখি হয়েছি। যাদের মধ্যে কারও হয়তো অপার সম্ভাবনা আছে, আবার কারও কোনো সম্ভাবনাই নেই। কেউ হয়তো অবস্থার পরিবর্তনের জন্য হরদম লড়াই করে চলেছে; আবার কেউবা চেষ্টা করার আগেই হেরে বসে আছে। আমি এমন মানসিকতার মানুষের সঙ্গে মিশেছি যারা প্রত্যেক নারীকে দেখে সমান চোখে; আবার এমন মানুষও দেখেছি যারা মেয়েদের মানুষই মনে করে না। এমন মেয়েদের দেখেছি যারা কর্মক্ষেত্রে সফল হয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে; আবার কেউ আছে যার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন সুন্দর একটা পরিবার। একটি বিষয়ে সবাই যেন এক। আর তা হলো বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা। দেশটির যে প্রান্তেই আমি গিয়েছি স্থানীয় লোকজন আমাকে এতটাই আপন করে নিয়েছে, যার গভীরতা কীভাবে ভাষায় প্রকাশ করা যায়, তা আমার জানা নেই।

বাংলাদেশে কাটানো আড়াই মাসের এ সময়টি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মনে থাকবে দিনে দশবার চা পান আর আড্ডাবাজি। প্রিয় হয়ে গেছে বাংলাদেশের সবজি আর ফলগুলো; যেগুলোর নাম পর্যন্ত আমি জানতাম না। তিন বেলা হাতে মেখে ভাত খাওয়ার কথাও মনে থাকবে। দেশটির সাধারণ মানুষ; যারা আমার নাম ‘মিনা’ জানলে মীনা কার্টুনের কথা বলেন—মনে থাকবে তাদের কথাও। কিংবা আমি ডেনিশ বংশোদ্ভূত জানলে ড্যানিশ কনডেন্সড মিল্কের কৌটা দেখিয়ে ফিক করে হেসে ফেলত! এটা আমার কাছে মজার এক অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে প্রিয় হয়ে থাকবে আমার বাংলাদেশের ‘পরিবার’ আর বন্ধুরা—যারা কখনো আমাকে বুঝতে দেয়নি আমি একজন ভিনদেশি। তাদের কাছে আমি ছিলাম ছোট্টবেলার মীনা কার্টুনের মতোই প্রিয় এক চরিত্র, যাকে কোনো শর্ত ছাড়াই ভালোবাসা যায়। মার্চে গিয়েছিলাম বাংলাদেশকে জানতে। উঠেছিলাম বনানীতে আমার বাংলাদেশি বন্ধু তৃণা সাত্তারের বাসায়। বাংলাদেশকে জানা বলতে অধিকাংশ মানুষ যা জানে তার বাইরে জেনেছি আমি। এ দেশে এমন কিছু মানুষ আছে যারা দিনবদলের আশায় খেটেই যাচ্ছে; যাদের কিছু পাওয়ার আশা নেই, তাদের শুধু আছে দেশের জন্য একবুক মায়া। এভাবে যদি তারা কাজ করতে থাকে তাহলে সেই দিনবদল খুব বেশি দূরে নয়। আমি খুব আগ্রহভরে এই পালাবদলের অপেক্ষায় আছি। যেমন অপেক্ষায় আছি ফের বাংলাদেশে যাওয়ার। দেখা হবে প্রিয় বাংলাদেশ।

আমি বেশি উপভোগ করেছি বাংলা বর্ষবরণ। পয়লা বৈশাখে টিপ আর শাড়ি পরে ছেলেমেয়েদের উদ্‌যাপন আর শত রঙে রাঙা মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমি কীভাবে মিশে গিয়েছিলাম, তা নিজেই জানি না! কারণ জানার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম গালে আলপনা এঁকে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করছি। এই শোভাযাত্রার মতো উৎসব আমি কখনো দেখিনি।

অনুবাদ: সামিহা আকবর