বিশ্বকাপের মাঠে অন্য রকম দায়িত্বে

সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে ডোপিং কন্ট্রোল অফিসার (ডিসিও) অধ্যাপক ক্লিনফিল্ড জেন্সের সঙ্গে আবদুল মতিন। ছবি: সংগৃহীত
সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে ডোপিং কন্ট্রোল অফিসার (ডিসিও) অধ্যাপক ক্লিনফিল্ড জেন্সের সঙ্গে আবদুল মতিন। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে রেপিনো শহরের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। বিশ্বকাপ খেলতে এসে এ শহরের ঘাঁটি গেড়েছে ইংল্যান্ড ফুটবল দল। তখন গ্রুপ পর্বের খেলা চলছিল। ফিফা ডোপিং নিয়ন্ত্রক দল সিদ্ধান্ত নিল ইংল্যান্ড দলের কয়েকজনের ডোপিং পরীক্ষা করাতে হবে। ডোপিং পরীক্ষা মানে কোনো খেলোয়াড় নিষিদ্ধ শক্তিবর্ধক ওষুধ, পানীয়, খাবার বা কোনো মাদকদ্রব্য গ্রহণ করেছে কি না, খেলোয়াড়দের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা-ই পরীক্ষা করে দেখা। সে দায়িত্ব পড়ল সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামের ডোপিং নিয়ন্ত্রক বিভাগের চার সদস্যের ওপর। এই চারজনের একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক আবদুল মতিন, রাশিয়ায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সুলতানপুরে মতিনদের বাড়ি। সেদিন মতিনের সামনে ডাক পড়েছিল ইংল্যান্ডের মধ্যমাঠের কান্ডারি জর্ডান হেন্ডারসনের।

শুধু ইংল্যান্ড দলই নয়। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে যত দল খেলেছে, সব দলের সদস্যদের ওপরই নজর রেখেছেন মতিনেরা। তাঁদের কাজই খেলোয়াড়দের দিকে কড়া নজর রাখা, সন্দেহ হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা। মতিনদের এ দায়িত্বের আনুষ্ঠানিক নাম ‘ডোপিং কন্ট্রোল শ্যাপেরন’—সংক্ষেপে ডিসিসি। এবারের বিশ্বকাপে যে ১১টি স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে, সেগুলোতে চারজন করে ৪৪ জন এ কাজ করছেন। মতিন আছেন সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে। এখানে তাঁর সঙ্গী ইতালি, নাইজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার তিনজন চিকিৎসক। এ চারজনের নেতৃত্বে আছেন জার্মান ডোপিং কন্ট্রোল অফিসার (ডিসিও) অধ্যাপক ক্লিনফিল্ড জেন্স। ফিফার ডোপিং কন্ট্রোল বিভাগের সহকারী হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মতিন দেখা পেয়েছেন বিশ্বের সেরা সব খেলোয়াড়ের। অল্প-বিস্তর কথা বলারও সুযোগ হয়েছে তাঁদের কারও কারও সঙ্গে।

১০ জুলাই মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। উচ্ছ্বসিত মতিন বলছিলেন, ‘দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। ব্রাজিলের তারকা ফুটবলার নেইমার, মিসরের মোহাম্মদ সালাহ, রাশিয়ার ডেনিস চেরিসভ, আর্জেন্টিনার ওতামেন্দি, নাইজেরিয়ার অবিমিকেলের মতো খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি।’ তারকা খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলার রোমাঞ্চ তাঁর কণ্ঠে ভেসে আসছিল। কথা বলতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। যেমন রাশিয়ার ডেনিস চেরিসভ যখন নাকি জানতে পারলেন মতিন বাংলাদেশি, চট করে তিনি বললেন, ‘তুমি জানো, বাংলাদেশে আমার যাওয়ার কথা ছিল। আমার বড় ভাই তোমাদের দেশে গিয়েছে, কিন্তু আমি তখন যেতে পারিনি। তবে ইচ্ছা আছে কোনো একদিন যাব।’

জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলতেন আব্দুল মতিন (দাঁড়ানো ডান থেকে তৃতীয়)
জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলতেন আব্দুল মতিন (দাঁড়ানো ডান থেকে তৃতীয়)

যেভাবে কাজ করতে হয় মতিনদের

আবদুল মতিনের কাজের ধরন কেমন? খেলা চলার সময় মতিনদের মাঠেই থাকতে হয়। এ সময়টা তাঁরা দুই দলের খেলোয়াড়দের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। এই পর্যবেক্ষণ চলে খেলার ৭৫ মিনিট ধরে। এরপর নির্ধারিত কক্ষে চলে আসেন। সেখানে উভয় দলের চিকিৎসক কিংবা ব্যবস্থাপকদের উপস্থিতিতে দুজন করে মোট চারজন খেলোয়াড়কে ডাকা হয়। ‘খেলোয়াড় নির্বাচন হয়ে থাকে দুভাবে—সন্দেহজনক মনে হলে কিংবা লটারির মাধ্যমে। আমরা চারজন একজন করে খেলোয়াড়ের জন্য সাইড লাইনে অপেক্ষা করতে থাকি। খেলার শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই খেলোয়াড়দের ডোপ টেস্ট সম্পর্কে বলি। ডোপ টেস্টের জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড় কোনোভাবেই নিজেদের ড্রেসিং রুমে যেতে পারেন না। সংবাদ সম্মেলন থাকলেও আমরা সার্বক্ষণিক খেলোয়াড়কে পর্যবেক্ষণে রাখি। তাঁদের রক্ত ও প্রস্রাব সংগ্রহ করে পরীক্ষা করি।’ বলছিলেন আবদুল মতিন।

ডোপিং কন্ট্রোল দলে যেভাবে

 ২০১৬ সাল। আবদুল মতিন তখনো সেন্ট পিটার্সবার্গের নর্থ-ওয়েস্টার্ন স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী। রাশিয়ায় বিশ্বকাপ উপলক্ষে ডোপিং নিয়ন্ত্রক বিভাগে লোক নেওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই জানেন তিনি। সংশয় নিয়ে আবেদন করেন। ফিফার কাছে জমা পড়ল মতিনের মতো বিশ্বের সাড়ে ২৭ হাজার আবেদনকারীর আবেদন। তার মধ্য থেকে মাত্র ৪৪ জনকে নির্বাচিত করে ফিফা।

মতিন তাঁদেরই একজন। মতিন বলছিলেন, ‘আমাকে বিভিন্ন ধাপে প্রায় ১০বার পরীক্ষায় বসতে হয়েছে। তবে এসব পরীক্ষার বাইরেও বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে স্পোর্টস মেডিসিনের ওপর ডিপ্লোমা কোর্স আমাকে সহায়তা করেছে। যেমন সহায়তা করেছে ২০১৭ সালের সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত ফিফা ভ্যালেন্টিন গ্রানাটকিন অনূর্ধ্ব-১৮ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং একই বছর কনফেডারেশন কাপে মেডিকেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা।’

ফুটবল খেলতেন মতিন

গল্প এগোয় আবদুল মতিনের সঙ্গে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে আমরা আসি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুরে। কৈশোরে সুলতানপুর মাঠের পাশেই ফুটবলের দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতেন মতিন। সুযোগ পেলেই মাঠে নেমে পড়তে বড় ইচ্ছা। কিন্তু বয়সে ছোট মতিনকে মাঠে বড়রা খেলতে নিত না। চেয়ে চেয়ে দেখাই তখন যেন তাঁর কাজ। তাতেই ভালো লাগে তাঁর। লাগবেই না কেন, ফুটবলের প্রতি তাঁর যে প্রবল টান। সুলতানপুর মাঠের পাশে বসে থাকা সেই কিশোরই একদিন ঠিকঠাক নেমে পড়েছিলেন মাঠে। তারপর গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে, স্কুলের ফুটবল দল ছাপিয়ে জেলা পর্যায়েও খেলেছেন। যেমন খেলেছেন বিমান অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে। কিন্তু পড়ালেখা আর পারিবারিক চাপে খুব তাড়াতাড়ি খেলাকে বিদায় জানাতে হবে, ভাবেননি মতিন। এরই মধ্যে শেষ করেন উচ্চমাধ্যমিক। রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করেন বৃত্তির। ২০০৫ সালে সুযোগ মেলে। উড়াল দেন বরফের দেশে।

২০১২ সালে রাশিয়ার রোস্তভ স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিবিএস ও এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের নর্থ-ওয়েস্টার্ন স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লিনিক্যাল অর্ডিনাটুরা ইন কার্ডিওলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমানে একই ইউনিভার্সিটিতেই কার্ডিওলজি বিষয়ে করছেন পিএইচডি।

আবদুল মতিনকে এলাকার মানুষ সেলিম নামে চেনে। বাবা হাফেজ আবদুর রহিম ও মা জোহরা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট মতিন। ২০১৫ সালে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া পড়ছেন ঢাকার শমরিতা মেডিকেল কলেজে। তাঁদের পাঁচ মাসের ছেলের নাম আহনাফ সাফওয়ান।

রাশিয়ার ওপার থেকে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে সময় কেটে যায়। মতিনের কথায় বোঝা যায় তাড়া আছে বেশ। কারণ, এই স্টেডিয়ামেই পরদিন (১১ জুলাই) খেলবে এমবাপ্পে, লুকাকুরা। নিজের প্রস্তুতির দরকার আছে। দুই সেমিফাইনালের একটি যে হবে এখানেই। আছে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচও। কথা শেষ করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। আমরা কথার শেষ দিকে যাই। একটি সুখবর দিয়ে শেষ করেন তিনি। কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের চিকিৎসা দলের সঙ্গে নাকি কথা হয়েছে তাঁর। সেখানেও থাকতে পারেন বাংলাদেশের আবদুল মতিন।