যাঁর দখলে দেশ ঘোরার বিশ্ব রেকর্ড

কাশী সমাদ্দার ভারতীয় বাঙালি পর্যটক। ২০০৮ সালে গড়েছেন সবচেয়ে বেশি দেশ ঘোরার রেকর্ড। যে কীর্তি এখনো তাঁর দখলে রয়েছে। ঢাকায় এসে রেকর্ড গড়ার এক দশক পূর্তিতে সেই গল্পই শোনালেন তিনি।

ঢাকায় সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছেন কাশী সমাদ্দার। উঠেছেন পল্টনের একটি আবাসিক হোটেলে। এটুকু জানার পর গুগলে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। চমকে উঠতে হলো, কাশী সমাদ্দার একজন বাঙালি পর্যটক। বিশ্বের সব কটি স্বাধীন দেশ ঘুরে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়েছেন। তিনি এসেছেন ঢাকায়। জুন মাসের এক সকালে তাঁর হোটেলে চলে যাই। আলাপ শুরু হলো। একটু উসকে দিতেই গড়গড় করে বলতে শুরু করেন নিজের পর্যটকজীবনের গল্প।

কাশী সমাদ্দার। ছবি: সংগৃহীত
কাশী সমাদ্দার। ছবি: সংগৃহীত

দেখব এবার জগৎটাকে
সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান কাশী সমাদ্দার। পড়াশোনায় ছিলেন মেধাবী। স্কুল ও কলেজ গ্রামের স্কুলে। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরি করেছেন। ১৯৯৪ সালে দিল্লির একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন তিনি। এরই মধ্যে নিজের দেশ ভারতের সব কটি রাজ্য ঘুরে শেষ করেন। সিদ্ধান্ত নেন, পরের বছর থেকে বিশ্ব দেখবেন।

১৯৯৫ সালে ভ্রমণ শুরু করেন নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে। এরপর মাত্র ৬ বছর ১০ মাস ৭ দিন সময়ের মধ্যে ১৯৪টি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। সর্বশেষ ১৯৫তম স্বাধীন দেশ দক্ষিণ সুদানে গিয়ে তিনি বিশ্ব রেকর্ড করেন। তিনি মনে করেন, এই জয় সব উন্নয়নশীল দেশের মানুষের। মানুষ তাঁর বিশ্ব রেকর্ডকে সম্মান করবে।

ঘুরেছেন ১৯৫টি দেশের ৫ হাজার ২০৭টি অঞ্চল
কাশী যখন ভ্রমণ শুরু করেন, তখনকার সময়ে কাজটা এত সহজ ছিল না। উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকের জন্য তো আরও কঠিন। এমন অনেক দেশ আছে, যারা বহুবার তাঁর ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘অথচ কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব থাকলে আরামসে সব দেশের ভিসা পেতাম,’ বলেন তিনি। এ বৈষম্য দূর করতেই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এসব জটিল পরিস্থিতি পার করেছেন তিনি।

উড়ে যায় হোটেলটি
ভ্রমণ করতে গিয়ে অনেকবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন কাশী। উত্তর মেরুতে একবার বরফচাপা পড়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে গিয়েও পড়েছিলেন মহা বিপদে। ‘কাবুলের যে হোটেলে ছিলাম, সেখান থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টা পর বোমার আঘাতে উড়ে যায় হোটেলটি,’ বললেন কাশী সমাদ্দার। কোনো কোনো দেশে ছিল অপহরণের ভয়, কোনো কোনো দেশ থেকে ফেরার সময় সাত-আটবার ফিরতি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। পূর্ব তিমুরে একবার তিন-চার দিন না খেয়ে ছিলেন তিনি। পরে কয়েকটি কলার জন্য এক শ ডলার খরচ করতে হয়।


বিশ্ব রেকর্ডের এক দশক
প্রথম বাঙালি, প্রথম ভারতীয়, প্রথম এশিয়ান, প্রথম কমনওয়েলথিয়ান এবং প্রথম একক পর্যটক (ফার্স্ট পারসন ভিজিটেড অল কান্ট্রিজ)* হিসেবে পৃথিবীর সব দেশ ঘুরে রেকর্ড করেছেন তিনি। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে কাশী সমাদ্দারের নাম উঠেছিল ২০০৮ সালের ২৭ মে। এ বছর রেকর্ডের এক দশক পূর্ণ হয়েছে। এ জন্য গর্বিত তিনি। তিনি চান বাঙালি মর্যাদার সঙ্গে বিশ্ব ঘুরুক।

পর্যটনের পাঁচ উদ্দেশ্য
বিশ্ব শান্তি, ভিসা বৈষম্যহীন বিশ্ব, শহরের জন্য বিশুদ্ধ হাওয়া, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমানো এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ে জনমত তৈরিতে কাজ করছেন কাশী সমাদ্দার। দেশে দেশে এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করছেন। তিনি মনে করেন, পর্যটনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান গড়ে ওঠে। তাতে যুদ্ধবিগ্রহ ও সামরিক ব্যয় কমে। গরিব দেশগুলোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশ তো পর্যটন থেকে আয় করেই টিকে আছে। বিশ্বনাগরিক হিসেবে যেকোনো দেশের ভিসা পাওয়ার অধিকার আছে যে কারও। শুধু উন্নত দেশের নাগরিকেরা অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাবে, সভ্য পৃথিবীতে এটা হতে পারে না।

এক বছরে ১০০ দেশ ভ্রমণ সম্ভব

ভ্রমণের আগ্রহ আছে জেনে পরামর্শ দিলেন, ‘চাইলে এক বছরে আপনি ১০০ দেশ ঘুরতে পারবেন। ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিনা মূল্যে বিদেশ ঘোরার ভিসা পরামর্শ দিয়েছি আমরা। ব্যাপারটা খরচসাপেক্ষ বলে এখন আর দিই না। তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ ই-মেইল করলে দেব।’ ছোট করে বলেছেন, ভ্রমণের জন্য দরকার ন্যূনতম ইংরেজি ভাষাজ্ঞান, আগাম রিটার্ন টিকিট ও হোটেল বুক করা। আর টাকা? আপনাকে স্পনসর জোগাড় করতে হবে।

ভ্রমণের প্রাপ্তি

ভালো বেতনের চাকরি, সঞ্চয়, বিদেশের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রেখে নেমেছিলেন ভ্রমণে। এ কাজে কারও কাছ থেকে কোনো অনুদানও নেননি। তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক এ ভ্রমণ করতে গিয়ে বহু কষ্ট সহ্য করেছি, প্রচুর আনন্দ পেয়েছি, পরিণত হয়েছি। সচেতন করতে চেষ্টা করেছি দেশগুলোকে। বলেছি, যেন সব জাতিকে ‘অন-অ্যারাইভাল ভিসা’ দেয়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো প্রথম আমার ডাকে সাড়া দেয়। অনেক দেশ করেনি বটে, তবে ভিসা সহজ করেছে অনেক দেশ। এতে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। আরও সফল হলে মেধা পাচার কমে গিয়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। এ কাজে পর্যটকদের এগিয়ে আসা উচিত। সারা পৃথিবীতে পর্যটন বিকশিত হলে কেউ আর গরিব থাকবে না।