কাপড় পেয়েই দরজির কাছে ছুট

.
.

নিজের জীবনে সেকালের অস্তিত্ব মানি না। হয়তো মানি না বলেই জানি না। আমার তো আছে আমার কাল। তার পত্তন হয়েছে শৈশব থেকেই, সে প্রায় ষাট বছর হলো। কম নয়, মানতেই হয়। তবু সেকাল নয়, শৈশবকাল আমার কালের সূচনা পর্ব।

শৈশবে সামান্যতেই আনন্দ মেলে। ঈদ মানেই আনন্দ। আমাদের বাড়িতে প্রথা পালনের কড়াকড়ি ছিল না। হিসাব হতো মানবিক গুণাবলির, কদর ছিল সংবেদনশীলতার। একবার বাবা আফসোস করে তাঁর এক সন্তান সম্পর্কে বলেছিলেন, ওর দুঃখবোধ বড্ড কম। অপরের দুঃখ সম্পর্কে উদাসীনতা দোষ।
অনেক ছেলে আট-নয় বছর বয়সেও রোজা রাখত বেশ। ছুটির পরে মৌলভি স্যারের ক্লাসে ওদের কাছে হারতে হতো আমাদের। তবে তার আগে আনন্দের কথাই বলি।
আমাদের শৈশবে মানুষ সত্যিই সমাজবদ্ধ প্রাণী ছিল। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী আর বন্ধুজনদের নিয়ে এ সমাজ। তবে বড় রাস্তার লাগোয়া আমাদের বাড়িটা ছিল বিচ্ছিন্ন। উত্তর পাশে সব দোকান, দক্ষিণে ধোপাপাড়া আর পেছনে দরিদ্র মানুষের আবাস। সামনে তো রাস্তা। একটু দূরে আত্মীয়বাড়ি—কাজির দেউড়ির কাজিদের বাড়ি, তাঁদের আত্মীয়দের ঘরবাড়ি।
বাবা আড্ডাবাজ নন, মা মিশুক প্রকৃতির। ওই ধোপাপল্লির গিন্নিদের আনাগোনা ছিল তাঁর কাছে। পেছনের দরিদ্র বধূদেরও সখ্য ছিল মায়ের সঙ্গে। ঈদের সপ্তাহ-দুসপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হতো। প্রথম ধাক্কায় আমাদের মানে ছোটদের আর ঝি-ভৃত্য দরিদ্র আত্মীয়দের জামাকাপড়। তখনো অত্যাধুনিক বিপণিবিতান হয়নি, মা যেত রেয়াজুদ্দিন বাজারে, মীরুখালার সঙ্গে। এসে বলত তোর জন্য খুব সুন্দর শার্টের কাপড় কিনেছি, সুন্দর সোবার কালার। তখন শিক্ষিত ভদ্রবাড়ির রুচির পরিচয় দিতে কাপড় হতো সোবার কালারের। মানে বাদামি, ঘিয়ে, হালকা নীল, ফিরোজা, বড়জোর হালকা গোলাপি।
একফাঁকে বলে রাখি, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা ছাড়াও দিয়েছে তারুণ্য। তাই স্বাধীন দেশে নব্বই ছুঁই-ছুঁই জাতীয় অধ্যাপক লাল ফতুয়া পরতেন কি আশি পেরোনো সাবেক প্রধান বিচারপতি গায়ে চাপাতেন বহুবর্ণিল সিল্কের শার্ট। কিন্তু সেদিন অধ্যাপক-লেখকের বাড়ির ছেলের গায়ে লালশার্ট অকল্পনীয়। হায় হায় রব উঠবে। জিনসের প্যান্ট দূরের কথা, অধ্যাপকেরা কদাচিৎ প্যান্ট-শার্ট পরতেন। পায়জামা-পাঞ্জাবিই ছিল দস্তুর।
কাপড় পেয়ে দরজির কাছে ছুটতে হতো। মাপ দেওয়ার এবং তারপর সেলাই করে দেওয়ার দিন নিয়ে দর-কষাকষি হতো। সেটা চলত এগিয়ে আনার জন্য। কারণ, তর সইত না।
নতুন জামা পাওয়ার পরে গায়ে চড়িয়ে মাকে সন্তুষ্ট করে আবার তার হাতেই সঁপে দিতে হতো। তারপর ধোয়া ও ইস্ত্রি এবং আলমারিতে সযত্নে লুকিয়ে রাখা। আর আশপাশে প্রতিদ্বন্দ্বী শিশুদের এবারের ঈদের জামার খোঁজ নেওয়া, চোখ রাখার কাজ চলত। তত দিনে না পরেই নতুন জামার প্রতি মায়া জমে যেত, ওটার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সন্দেহ থাকত না।
ঈদের দিন ছেলেরা সকাল সকাল স্নান সেরে বাবার সঙ্গে মসজিদে যাওয়ার জন্য তৈরি হতাম। পাড়ার মসজিদ। পাড়ার বড় দোকানের মালিক পেয়ার মোহাম্মদ সওদাগর সেদিন স্বেচ্ছাব্রতী হয়ে মসজিদের মাইকে পাড়ার মুসল্লিদের হাঁকাহাঁকি করে জামাতে ডাকতেন সকাল থেকে।
এদিকে মা ভোররাত থেকে রান্নাঘরে। তখন তো ফ্রিজ ছিল না। ফলে রাত থাকতে উঠে রান্না চড়াতে হতো। মার একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিল কাজিবাড়ির বধূদের সঙ্গে। কে আগে দুরকম সেমাই রান্না করে পাঠাতে পারে। মা প্রতিবছর এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী। প্রতিবছর ওদের বাড়ির মেয়েরা এসে বলত—জেঠিমার সঙ্গে কেউ পারবে না। সকাল সকাল কীভাবে যে তৈরি করে ফেলেন সব। মার বিজয়ী হাসিটি হতো চমৎকার।

.
.

সব ঈদে সবার জন্য প্যান্ট-শার্ট-জুতো হবে না। যেবার জুতো হবে, সেবার উত্তেজনা বেশি। তবে তখনকার জামার রং সোবার হলেও জুতোর চামড়ার ঢং ছিল বেয়াড়া প্রকৃতির। কিছুক্ষণ হাঁটার পরে পা কাটত। প্রায়ই দেখা যেত বিকেলের দিকে ক্লান্ত-শ্রান্ত ছেলে-বুড়োর দল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরছে। তখন মুখে ঈদের আনন্দের কোনো ছাপ থাকত না।
তখন গরিব মানুষ, এমনকি ভিখিরিরাও পরিচিতজনই ছিল। নিয়মিত আসত, অনেকটা দূরের আত্মীয়ের মতো। প্রতি ঈদে ওদের দু’একজন করে কাপড় পেত— শাড়ি-লুঙ্গি। সত্যি বলতে কী, আমার মার গুণে আমাদের জমাদার, মায় পাড়ার পাগলিনি কমলাও ঈদে কিছু পেত। কাউকে খাওয়া, কাউকে সঙ্গে কাপড়।
তখনকার এই অন্তর্ভুক্তির সংস্কৃতি এখন হারিয়ে গেছে। এখন পরিবার কেবল ছোট নয়, বিচ্ছিন্নও। আশ্রিত মামা-খালা কি ভাইবোন নিয়ে সম্প্র্রসারিত পরিবারের কোনো ধারণাই নেই, অস্তিত্বও নেই। ফলে মধ্যবিত্তেরও নিজ পরিবারের তিন-চার সদস্যের জন্য খরচের ক্ষমতা বেড়েছে। মানুষের কেনাকাটার ক্ষমতাও বেড়েছে, ইচ্ছাও। ফলে শুনি ছেলেমেয়েদের একেকজনের পাঁচ-সাত-দশটা করে নতুন জামা হয় ঈদে। সত্যি তেলা মাথায় তেল দেওয়ার রেওয়াজও বেড়েছে। অর্থাৎ আছে যাদের দেদার তারা পরস্পর দেওয়া-থোয়া করছে। যাদের নেই তাদের চৌকাঠের বাইরে রেখে ভিখিরি হিসেবেই দান দেয় বড়জোর। দূরে ঠেলে দানে আমার মায়ের মনুষ্যত্ববোধ, বাবার বেদনশীলতা ক্ষুণ্ন হয়। তারা কাজের লোক, ভিখিরি, হ্যাঁ পাড়ার পাগলকেও পরিবারের লোক ভাবত। তারা আয়োজন করে পরোপকার জানত না, ও ছিল জীবনযাপনেরই অংশ। আলাদা কিছু নয়। পুণ্যের লোভ, পরকালের কথা ভেবেও নয়। স্রেফ জীবনযাপনেরই ধারাবাহিকতা। এখনকার ইফতার-ইফতার পার্টির আড়ম্বর ও বাহুল্য এবং ঈদে আত্মকেন্দ্রিক ভালো খাওয়া ভালো-থাকার দৌড় দেখে তাঁরা নিশ্চয় ভাবতেন, প্রকৃত ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে মানুষ।
মানুষের এখন চলছে ধনের সাধনা। ধন দূরত্ব তৈরি করছে, দানের বেশি সে জানে না, পারে না। সমাজে অন্তর্ভুক্তির সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। সংকট বাড়ছে।
ঈদের দিনে আজকাল বড় করে চোখে লাগছে উদ্যাপনের বৈষম্য। যেন সমাজ নিজেই বলছে দ্যাখো দ্যাখো, মানুষ মানুষে কী রকম ফারাক তৈরি করেছ তোমরা। দ্যাখো, আনন্দে আর অশ্লীলতায় ফারাক দেখছ না তোমরা।
কায়মনে প্রার্থনা একটিই, ঈদ উপলক্ষে সমাজটা যেন মানুষেরই থাকে। ধর্ম যে সাম্য এবং সবার কথা বলেছে, সে বাণী যেন আমাদের মনে থাকে।