ঘর-মন-জানালা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শুনেছিলাম, মাকে কথা দিয়েছিলে, ফিরে আসবে। কথা দিয়েছিল অনেকেই; কেউ ফিরে আসেনি, যেমনটা তুমি কথা দিয়েও কথা রাখোনি। এমন একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীতে হাসিমুখ, সুখ, রঙিন আলোর মেলা শূন্য হয়ে পড়েছিল; ছিল শুধু অস্তিত্ব কিন্তু ছিল না তার বিকাশ। হঠাৎ পৃথিবীতে লাল, নীল আলোর সন্ধান পাওয়া গেল; সবাই মেতে উঠল আনন্দে; যে মুহূর্তে তুমি জন্মালে এ পৃথিবীতে। সম্পর্ক কোনো জ্বলন্ত মোমবাতির মতো খানিক সময়ের জন্য স্বস্তি নয়। অথচ অভিমানী তুমি; ঝঞ্ঝামুখর পরিস্থিতিতে বুকে আগলে রাখার পরিবর্তে হিমশীতল শবঘরে নিথর-নিশ্চল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে! বাতাসের প্রকোপে প্রদীপ নেভার আগে শেষবারের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে; তেমনি তুমি জ্বলেও ছারখার করে দিয়েছ হাজারো সম্পর্ককে; যেমনটি পিতা-পুত্রের বন্ধনকে। শুধু বলেই দেখতে; জীবন বাজি রেখে একবার তোমাকে মুক্ত করেছিলাম; প্রয়োজন পড়লে সহস্রাধিক ঝুঁকি নিয়ে তোমায় ফিরিয়ে আনতাম। বর্ষার সেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে যখন বসে ছিলাম আমি; চারিদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, হঠাৎ করে জ্বলে উঠল বজ্র; আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সুবিস্তৃত আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। আমি বুঝতে পারিনি; আমি যে ছিলাম অবুঝ! শুনতে পেলাম, সেই বজ্রপাত। আমি লুকিয়ে পড়েছিলাম; ভেবেছিলাম, বেঁচে গিয়েছি। তখনো বুঝতে পারিনি আমার জীবন যে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আমি বুঝতে পারিনি কেউ যে আমার নেই; চারিদিকে শুধু হাহাকার, আমি শুধু হতবাক হয়ে চেয়ে আছি আকাশের কোণে; হারিয়ে ফেললাম প্রিয়জনকে; বাবা, তোমাকে।

কতটা ভালোবাসলে তুমি আবার জেগে উঠবে! পূর্ণিমার চাঁদ যদি হাতের মুঠোয় নিয়ে আসি তুমি কি সাড়া দেবে? কতটা সময় স্মরণ করলে তুমি আবার জেগে উঠবে? আকাশের সব তাঁরা যদি আমার চোখের মধ্যে নিয়ে আসি, তুমি কি সজাগ হবে? কয়টা চিঠি লিখলে তুমি আবার জেগে উঠবে? পৃথিবীর সব চিঠি জোগাড় করলে কি তুমি উঠে দাঁড়াবে? কতগুলো ভাষা জানলে তুমি আবার ফিরে আসবে? সব ভাষা জেনে তোমাকে ডাকলে কি তুমি সত্যি ফিরে আসবে? কয়টি পদ্য লিখলে তুমি আবার দৃশ্যমান হবে? লক্ষাধিক পদ্যকার উপস্থিত করলে কি তুমি জড়িয়ে ধরবে? তুমি ফিরে আসবে, আসবে বলেও কথা রাখোনি। তুমি ফিরে আসোনি বলে তোমাকে আমিও মনে রাখিনি। পৃথিবীর এই কঠিন নির্মম বাস্তবে তোমাকে প্রতিক্ষণে স্মরণ করিনি; এই অভিমানে তুমি আর ফিরে আসোনি।

লেখক: প্রয়াত বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের ছেলে