বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে দুটি প্রস্তাব

ভূমিকা

বিরোধী দলের ডাকে আবার দেশব্যাপী হরতাল পালিত হচ্ছে। অনেকে এ হরতালের ডাকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। প্রথমত, ১/১১-এর পটপরিবর্তন ও তদসঞ্জাত ঘটনাবলির আলোকে অনেকে ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশ বুঝি বা হরতালের রাহুমুক্ত হলো। দ্বিতীয়ত, যাঁরা হরতাল দূরীভূত হওয়ার ব্যাপারে ততটা আশাবাদী হতে পারেননি, তাঁরা অন্তত এটুকু আশা করেছিলেন যে আগের মতো অতো ঘন ঘন হরতাল ডাকা হবে না। কিন্তু বাস্তবে হরতাল ডাকা হলো এবং তা ইঙ্গিত দেয় যে ভবিষ্যতে আরও অনেক হরতাল হবে। বিরোধী দল ক্রমাগতভাবে সংসদ বর্জন করে যাচ্ছে এবং সংসদের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায়ের কোনো চিন্তা দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই বিরোধী দল সরকার পতনের আওয়াজ তুলেছে এবং তা থেকে স্পষ্ট যে এ লক্ষ্যে ভবিষ্যতে তারা রাজপথের আন্দোলন গড়ে তুলবে। সুতরাং খুবই আশঙ্কা যে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আরেকটি পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

কেন এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং তা নিরসনের উপায় কী? এ প্রশ্নগুলো আজ বহুদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। ১/১১-এর পরিবর্তনের ফলে জাতি বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও অতিক্রম করল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে অস্থিতিশীলতার সমস্যাটি থেকেই যাচ্ছে। তাহলে কি এ সমস্যা থেকে বেরোনোর কোনোই উপায় নেই? বাংলাদেশে কি গণতন্ত্র কখনোই স্থিতিশীল হবে না?

গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত

লক্ষণীয় যে গণতন্ত্রের অস্থিতিশীলতার সমস্যা কেবল বাংলাদেশের একার নয়। উন্নয়নশীল আরও অনেক দেশকেই এ সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। এ সমস্যার মূল কারণ, এসব দেশের অর্থনৈতিক পশ্চাত্পদতা। বিকশিত পুঁজিবাদী সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ কয়েক শতাব্দী ধরে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। সময়ে পুঁজিবাদী দেশগুলোয় অর্থনীতি যত বিকশিত হয়েছে, ততই সর্বজনীন ভোটাধিকারভিত্তিক গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে। এমনকি যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও মহিলাদের ভোটাধিকারের জন্য প্রায় ১৯২০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আজ যখন উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের অবিকশিত অর্থনীতি নিয়েই বিকশিত পুঁজিবাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করতে চেষ্টা করছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের একটা অসংগতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং সেই মূল অসংগতির কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সমস্যা তারই একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ।

ইতিহাস দেখায় যে এ দেশের মানুষ অগণতান্ত্রিক শাসন দীর্ঘদিন মেনে নেয় না। কাজেই বাংলাদেশ যেন এক উভয় সংকটে নিপতিত: একদিকে গণতন্ত্রের বিকল্প নেই, অন্যদিকে গণতন্ত্র স্থিতিশীলও হতে পারছে না।

এদিকে আবার কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা দেখায় যে অর্থনৈতিক পশ্চাত্পদতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রচর্চা সম্ভব। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ প্রতিবেশী ভারত। নব্বইয়ের দশক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায়ও গণতন্ত্রের ভালো চর্চা হচ্ছে। লাতিন আমেরিকার কোস্টারিকাসহ আরও কত উন্নয়নশীল দেশেও গণতন্ত্র কাজ করছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি সাপেক্ষে তুলনামূলকভাবে পশ্চাত্পদ অর্থনীতিসম্পন্ন উন্নয়নশীল দেশও গণতন্ত্রচর্চায় সফল হতে পারে। কাজেই বাংলাদেশেও গণতন্ত্র সফল হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, কী কী পদক্ষেপ বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করতে পারে?

গণতন্ত্র স্থিতিশীলকরণের প্রাতিষ্ঠানিক পন্থা

বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে প্রস্তাবের অভাব নেই। এর মধ্যে একধরনের প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা ছিল ব্যক্তিনির্ভর। ধারণা করা হয়েছিল, কোনো কোনো ব্যক্তি রাজনীতি থেকে অবসর নিলে এবং/অথবা কোনো কোনো ব্যক্তি রাজনীতিতে প্রবেশ করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সমস্যার সমাধান হবে। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে এই ব্যক্তিনির্ভর পন্থা সম্ভব অথবা কার্যকর নয়। ব্যক্তিনির্ভর পন্থার বদলে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রক্রিয়ানির্ভর পন্থা।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক পন্থানির্ভর প্রচেষ্টার একটি উদাহরণ হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালে এ প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের কিছু কুফল দেখা দিয়েছে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Law of unintended consequences| তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রাজনীতিকরণের প্রয়াস। ফলে ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি বহাল রাখা ঠিক হবে কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ব্যবস্থার উদ্ভাবন একটি সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টা ছিল এবং এর অধীনে এ পর্যন্ত চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি বাতিলও হয়, তবুও বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হবে।

একইভাবে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপগুলোও প্রাতিষ্ঠানিক পন্থার আরেকটি উদাহরণ। তবে এই প্রচেষ্টার প্রকৃতি কিছুটা ভিন্ন ধরনের এবং তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থার মতো মৌলিক চরিত্রের নয়।

গণতন্ত্র
গণতন্ত্র

এই সূত্রে আরও লক্ষণীয়, অর্থনীতি ও সমাজ সর্বদা গতিশীল। কাজেই কোনো একটি পর্বেও যদি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন বাংলাদেশের গণতন্ত্রচর্চার জন্য সহায়ক হয়, তা সেই পর্বে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। ফলে অবিকশিত অর্থনীতির যে মূল কারণে গণতন্ত্র অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন, সেই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশকে খানিকটা হলেও অগ্রসর করে নিয়ে যাবে।

সুতরাং বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র স্থিতিশীল করতে হয়, তাহলে উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা অর্জনের কথা ভাবতে হবে। সেই উপলব্ধি থেকে এ প্রবন্ধে দুটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হচ্ছে। একটি হলো সরকারের মেয়াদ বর্তমানের পাঁচ থেকে চার বছরে হ্রাস; আর দ্বিতীয়টি হলো বর্তমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক পদ্ধতির বদলে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন-ব্যবস্থার প্রবর্তন।

সরকারের মেয়াদ হ্রাস

অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের বিরোধী দল দীর্ঘ পাঁচ বছর ধৈর্য ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকতে প্রস্তুত নয়। তারা তৃতীয় বছর থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে দেয় এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে লাগাতার হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক কর্মসূচি গ্রহণ করে। কোনো রকম অনুরোধ, উপরোধ তাদের এ রকম আচরণ থেকে এযাবত্ বিরত করতে পারেনি।

সরকারের মেয়াদ হ্রাস বিরোধী দলের এ রকম আচরণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত, চার বছরের মেয়াদ মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবির যৌক্তিকতা খুবই দুর্বল করে দেবে। দ্বিতীয়ত, এতদসত্ত্বেও যদি বিরোধী দল মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তোলে, তা জনগণের তেমন সমর্থন পাবে না। বরং অযৌক্তিক দাবি উত্থাপন ও তা আদায়ের লক্ষ্যে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক আন্দোলনের কারণে বিরোধী দল জনগণের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা এবং সে আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে বিরোধী দলও সেই পথে অগ্রসর না হওয়ার চাপ অনুভব করবে।

একবার যদি মধ্যবর্তী নির্বাচনের যৌক্তিকতা ও সম্ভাবনা এভাবে বাতিল করা যায়, তাহলে সংসদের প্রতি অধিকতর মনোযোগী হওয়া ছাড়া বিরোধী দলের গত্যন্তর থাকবে না। কাজেই সরকারের মেয়াদ হ্রাস, একই সঙ্গে রাজপথের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের আবেদন হ্রাস ও সংসদের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি, উভয় লক্ষ্য অর্জনেই সহায়ক হবে।

ঘন ঘন নির্বাচনের আরও কিছু সুফল সহজেই অনুমান করা যায়। যেমন—এতে করে সরকার ও সাংসদদের জবাবদিহি বাড়বে, যেহেতু শিগগিরই তাদের আবার নির্বাচনের সম্মুখীন হতে হবে। অন্যদিকে এর ফলে জনগণের ভূমিকাও বাড়বে। অনেক সময়ই অভিযোগ শোনা যায় যে মন্ত্রীরা কিংবা সাংসদেরা কেবল নির্বাচন এলেই জনগণের কাছে যান; বাকি সময় তাঁদের সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘন ঘন নির্বাচন হলে জনপ্রতিনিধিরা ঘন ঘন জনগণের কাছে যেতে বাধ্য হবেন।

অনেক সময় বলা হয় যে ঘন ঘন নির্বাচন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। আমরা দেখছি যে বরং উল্টো। ঘন ঘন নির্বাচন না হওয়ার কারণেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের সৃষ্টি হচ্ছে।

কেউ কেউ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সরকার দরকার। কিন্তু ঘন ঘন নির্বাচন সে ক্ষেত্রেও কোনো বাধা নয়। কোনো সরকার যদি সত্যিই ভালো কাজ করে, তবে ওই সরকার পুনর্নির্বাচিত হবে এবং তার ভালো কাজ অব্যাহত রাখবে। পক্ষান্তরে যদি কোনো সরকার ভালো না হয়, তাহলে যত তাড়াতাড়ি জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে ওই সরকার পরিবর্তনের সুযোগ পায়, ততই তো ভালো।

কেউ বলতে পারেন যে ঘন ঘন নির্বাচন ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু এটা তেমন ভালো যুক্তি নয়। সরকারের মেয়াদ পাঁচের বদলে চার বছর হলে ২০ বছরে চারটির বদলে পাঁচটি নির্বাচন করতে হবে। এটা তেমন বড় কোনো ব্যয় বৃদ্ধি নয়। বরং এই ২০ বছরের মধ্যে প্রায় ১০ বছর যদি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন হয়, তাতে অর্থনীতির আরও বহুগুণ ক্ষতি সাধিত হবে।

কাজেই সব মিলিয়ে সরকারের মেয়াদ হ্রাসের অপকারিতার বদলে উপকারিতাই বেশি। সুতরাং বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে এ প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনটি গ্রহণ করা বেশ সমীচীন হবে। লক্ষ করা যেতে পারে যে পাঁচ বছরের মেয়াদের প্রথাটি আমরা ব্রিটিশ শাসনের সূত্রে পেয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই সরকারের মেয়াদকাল এর চেয়ে কম। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের মেয়াদ চার বছর। অস্ট্রেলিয়ায় তা আরও কম, মাত্র তিন বছর। কাজেই বাংলাদেশকে যে চিরকাল ব্রিটিশরীতি অনুসরণ করে যেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বড় কথা হচ্ছে, দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির জন্য কোনটি শ্রেয়।

অভিজ্ঞতার নিরিখে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের জন্য সরকারের পাঁচ বছরের মতো দীর্ঘ মেয়াদ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অনুকূল হচ্ছে না। সুতরাং এ মেয়াদ কমিয়ে আনাই বাঞ্ছনীয়। লক্ষণীয় যে এ পরিবর্তন আনয়ন তুলনামূলকভাবে সহজ। এর জন্য জটিল কোনো সাংবিধানিক সংশোধন প্রয়োজন নেই। সামান্য একটি সংখ্যার পরিবর্তনই যথেষ্ট। তেমনিভাবে যদি অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে এই পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত ফললাভে সহায়ক হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদে প্রত্যাবর্তনও কঠিন হবে না।

আনুপাতিক হারের নির্বাচন

দ্বিতীয় প্রস্তাবিত প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনটি হলো বর্তমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির বদলে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন প্রবর্তন। এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বোঝার জন্য সারণি-১  বেশ সহায়ক হবে। এতে সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোট ও আসনসংখ্যাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।

 সারণি-১

সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় বিভিন্ন দলের ভোট ও আসনসংখ্যা

 

 

বছর

আওয়ামী লীগ

বিএনপি

জাতীয় পার্টি

অন্যান্য

ভোট অনুপাত (%)

 

আসন সংখ্যা ও অনুপাত (%)

ভোট অনুপাত (%)

আসন সংখ্যা ও অনুপাত (%)

ভোট অনুপাত (%)

আসন সংখ্যা ও অনুপাত (%)

ভোট (%)

 

আসন সংখ্যা ও অনুপাত (%)

১৯৭৯

২৪.৬

৩৯

(১৩.০)

৪১.২

২০৭

(৬৯.০)

 

 

৩৪৩

৫৪

(১৮.০)

১৯৯১

৩৩.৩

১০০

(৩৩.৩)

৩০.৮

১৪০

(৪৬.৭)

১১.৮

৩৫

(১১.৭)

২৭৩

২৫

(৮.৩)

১৯৯৬

৩৭.৪

১৪৬

(৪৮.৭)

৩৩.৬

১১৬

(৩৮.৭)

১৬.২

৩১

(১০.৩)

১২৭

(২.৩)

২০০১

৪০.১

৬২

(২০.৭)

৪৭.০

২১৬

(৭২.০)

৭.৩

১৪

(৪.৭)

৫৬

(২.৭)

২০০৮

৪৯.০

২৩০

(৭৬.৭)

৩৩.২

৩০

(১০.০)

৭.০

২৭

(৯.০)

১০৮

১৪

(৪.৭)

এই সারণি থেকে দেখা যায়, দলগুলো কর্তৃক প্রাপ্ত ভোট ও আসনসংখ্যার মধ্যে প্রায়ই বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ২১ শতাংশ আসন পেয়েছিল।

আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৮ সালে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭৭ শতাংশ আসন পেয়েছে। তেমনই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০০১ সালে ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭২ শতাংশ আসন পেয়েছিল; আবার ২০০৮ সালে ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ১০ শতাংশ আসন পেয়েছে।

এই ব্যবধানের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হলো বিপরীত ফল: অর্থাত্ ভোট অনুপাত বাড়া সত্ত্বেও আসনসংখ্যা কমে যাওয়া। যেমন—আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ৩৭ শতাংশের তুলনায় ২০০১ সালে ভোট পেয়েছিল ৪০ শতাংশ; অথচ আসনসংখ্যা বাড়ার বদলে ১৪৬ থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল ৬২-তে। তেমনই বিএনপি ১৯৯১ সালের ৩১ শতাংশের তুলনায় ১৯৯৬ সালে ভোট পেয়েছিল ৩৪ শতাংশ; অথচ আসনসংখ্যা ১৪০ থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল ১১৬-তে।

ভোট অনুপাত ও আসনসংখ্যা অনুপাতের মধ্যে এ ধরনের ব্যবধান ও বিপরীত ফলের কারণ হলো বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি। এর ফলে কোনো একটি আসনে যে সর্বোচ্চ ভোট পায়, কেবল সেই জেতে; বাকিদের প্রাপ্ত ভোট কোনোভাবেই ফলদায়ক হতে পারে না। নির্বাচনের এই পদ্ধতি বিপুলসংখ্যক মানুষের ভোটকে অকার্যকর করে দেয়। বাংলাদেশে নির্বাচনের এ পদ্ধতির বহু নেতিবাচক প্রতিফল দেখা দিচ্ছে। তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নিম্নরূপ:

প্রথমত, এ পদ্ধতির কারণে নির্বাচনে কারচুপির সুযোগ ও উত্সাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ সামান্য ভোটসংখ্যার পরিবর্তনের মাধ্যমেই আসনসংখ্যার বিপুল পরিবর্তন করা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, যেহেতু এ নির্বাচন পদ্ধতিতে কারচুপি এত কার্যকর, সেহেতু নির্বাচনে টাকা ও পেশিশক্তির (মাস্তানদের) প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ নির্বাচনে কারচুপির জন্য এসব প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, নির্বাচনে প্রতিযোগীদের মানের অবনতি ঘটছে, কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদেরই মনোনয়ন দিতে বাধ্য হচ্ছে, যাঁদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জিতে আসার মতো টাকা ও পেশিশক্তি রয়েছে।

চতুর্থত, এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তৃত্ব হ্রাস পাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে দলগুলো নির্বাচনে জেতার জন্য স্থানীয় মাস্তানদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে।

পঞ্চমত, যেহেতু ভোট অনুপাতের সামান্য পরিবর্তনই নির্বাচনের গোটা ফলাফল বদলে দিতে পারে, সেহেতু অল্প ভোট বৃদ্ধির জন্য দলগুলো বিভিন্ন অশুভ রাজনৈতিক জোটে আবদ্ধ হচ্ছে। ফলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে দলগুলো তাদের প্রকৃত পরিচয় জনগণের কাছে সব সময় তুলে ধরতে পারছে না।

ষষ্ঠত, যেহেতু একেকটি নির্বাচনী এলাকা থেকে জিতে আসাটাই একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়, সেহেতু জাতীয় ও বৃহত্তর ইস্যুর বদলে স্থানীয় ইস্যুই এলাকাগুলোয় বেশি গুরুত্ব লাভ করে। ফলে এলাকায় নির্বাচনী প্রচারাভিযান অনেক সময় জাতীয় ইস্যুগুলোর প্রতি দৃষ্টি প্রসারণের পরিবর্তে কূপমণ্ডূকতার দিকে ধাবিত হয়।

সপ্তমত, এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের কারণে সাংসদদের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের সংঘাত দেখা দিচ্ছে। যদিও সাংসদদের মূল দায়িত্ব জাতীয় জীবনের জন্য প্রযোজ্য আইন প্রণয়ন, তাঁরা বরং স্থানীয় সরকারের স্থলাভিষিক্ত হওয়ায় সচেষ্ট হচ্ছেন এবং এর ফলে স্থানীয় সরকার বিকশিত হতে পারছে না।

অষ্টমত, সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির ফলে ছোট রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র অংশগুলোর পক্ষে সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব অর্জন দুরূহ হচ্ছে। এর ফলে তাঁরা দেশের সংসদভিত্তিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে দৃঢ় সম্পৃক্তি অনুভব করতে পারছেন না এবং অনেক সময় সংসদ-বহির্ভূত কার্যক্রমে লিপ্ত হচ্ছেন।

এসব বিভিন্ন কারণে বর্তমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচনের বদলে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনই বাংলাদেশের জন্য শ্রেয় হবে। বাংলাদেশের জন্য আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের সুফলগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নিম্নরূপ:

প্রথমত, এ পদ্ধতিতে ভোটের অনুপাত ও আসনসংখ্যার অনুপাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। ফলে বিপরীত ফলেরও কোনো সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত, যেহেতু ভোট অনুপাতের অল্প পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফলের বড় পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই, সেহেতু এ পদ্ধতিতে নির্বাচনী কারচুপির সুযোগ কমে যাবে।

তৃতীয়ত, কারচুপির সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে কারচুপি করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা ও পেশিশক্তির আবশ্যকতাও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা।

চতুর্থত, আনুপাতিক পদ্ধতির ফলে নির্বাচনে প্রার্থীদের মানের উন্নতি ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেহেতু এ পদ্ধতিতে নির্বাচনী এলাকা দেশজুড়ে বিস্তৃত হবে, সেহেতু বিভিন্ন দলের নির্বাচনী প্রার্থী তালিকায় জাতীয় পরিচিতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের স্থান পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। তদুপরি জাতীয় সংসদের মূল কাজ জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে নীতি ও আইন প্রণয়ন, সেহেতু নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের মাধ্যমে যাঁরা জাতীয় পর্যায়ে উন্নীত হতে পেরেছেন, নির্বাচনী প্রার্থী তালিকায় তাঁদের স্থান পাওয়া জাতীয় সংসদের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনের সঙ্গে অধিকতর সংগতিপূর্ণ হবে।

পঞ্চমত, যেহেতু নির্বাচনে জেতার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের অর্থ ও পেশিশক্তির ওপর নির্ভরতা কমে যাবে, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো আরও সংহত ও সুসংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে। দলগুলোর প্রার্থী তালিকা নির্ধারণে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এবং গোটা দলের ভূমিকা বৃদ্ধি পাবে।

ষষ্ঠত, নির্বাচনে যাওয়ার জন্য কোনো জোট বাঁধার প্রয়োজনীয়তা থাকবে না; ফলে সব দল তাদের প্রকৃত পরিচয়সহকারে জনগণের কাছে হাজির হতে পারবে এবং তাতে করে জনগণ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ ধারণা পাবে।

সপ্তমত, যেহেতু আনুপাতিক নির্বাচনী এলাকা দেশজুড়ে বিস্তৃত হবে, সেহেতু নির্বাচনী প্রচারাভিযান স্থানীয় কূপমণ্ডূকতার পরিবর্তে বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুর প্রতি বেশি নিবদ্ধ হবে এবং এর ফলে নির্বাচনের প্রচারাভিযানের মানের উন্নতি সাধিত হবে।

অষ্টমত, আনুপাতিক নির্বাচন বর্তমানে সাংসদদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের যে সংঘাত চলছে তার অবসান করবে, কারণ এ পদ্ধতির অধীনে নির্বাচিত সাংসদেরা কোনো নির্দিষ্ট স্থানের প্রতিনিধিত্ব করবেন না; ফলে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে তাঁদের বিরোধের আশঙ্কা কমে যাবে। এর ফলে স্থানীয় সরকারের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

নবম, আনুপাতিক নির্বাচন ছোট-বড়, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগরিষ্ঠ, সবার জন্য প্রতিনিধিত্ব অর্জনের সমান সুযোগ সৃষ্টি করবে। একটা খবাবষ ঢ়ষধুরহম ভরবষফ সৃষ্টি হবে। ‘ভোট অপচয়ের’ সমস্যা তিরোহিত হবে। ফলে সংসদ আরও বেশি প্রতিনিধিত্বশীল হবে, সমাজের সব অংশ সংসদের সঙ্গে সম্পৃক্তি বোধ করবে এবং তা জাতীয় সংহতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

দশম, সর্বোপরি যেহেতু আনুপাতিক পদ্ধতিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও বিপরীতমুখী ফলাফলের সুযোগ  কম হবে, সবার জন্য প্রতিনিধিত্ব অর্জনের সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে, সেহেতু এ পদ্ধতি অধিকতর ন্যায্য বলে প্রতীয়মান হবে। এর ফলে তা দেশে অধিকতর শান্তিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করবে, কেননা ন্যায়ের নিশ্চিতকরণ সব সময়ই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক।

অনেক সময় বলা হয়ে থাকে যে আনুপাতিক নির্বাচন কেবলই কোয়ালিশন সরকারের জন্ম দেবে; বড় দলগুলোকে ক্ষুদ্র দলের ওপর নির্ভরশীল করবে এবং তার ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। ঘনিষ্ঠ বিচারে দেখা যায়, এসব যুক্তি সঠিক নয়। বাংলাদেশে আনুপাতিক নির্বাচন না হওয়া সত্ত্বেও কোয়ালিশন সরকার হচ্ছে এবং বড় দলগুলো অনেক সময় ছোট দলের ওপর সরকার গঠনের জন্য নির্ভরশীল হচ্ছে। আনুপাতিক নির্বাচন বরং কোয়ালিশন গঠনকে আরও পরিচ্ছন্নতা দেবে। কারণ, নির্বাচনের আগে কোনো জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সত্যিকার নিজ শক্তি প্রমাণিত হবে, কেবল তার ভিত্তিতেই নির্বাচন পরবর্তীকালে প্রয়োজন বোধে জোট গঠনের প্রক্রিয়া অগ্রসর হতে পারবে।

আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির একটি দুর্বলতা হলো সংসদে ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা। তবে এ সমস্যা প্রশমনের বিভিন্ন উপায় রয়েছে। যেমন নির্বাচনী এলাকা গোটা দেশভিত্তিক না হয়ে বড় বড় ভৌগোলিক অঞ্চলভিত্তিক (যেমন বাংলাদেশের পুরোনো বিভাগগুলো তথা ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম বিভাগ) হতে পারে। ধরা যাক, এসব বিভাগের জনসংখ্যা সমান এবং সংসদের আসনসংখ্যা ৩০০। সে ক্ষেত্রে প্রতি বিভাগ থেকে ৭৫ জন সাংসদ নির্বাচিত হতে পারেন। এ পদ্ধতিতে বিভাগভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্ব অর্জনের দ্বিতীয় উপায় হলো সংসদে আনুপাতিক ভিত্তিতে নির্বাচিত সদস্যদের পাশাপাশি নির্দিষ্টসংখ্যক ভৌগোলিক ভিত্তিতে নির্বাচিত সদস্যদের স্থান করে দেওয়া। ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্ব অর্জনের তৃতীয় উপায় হলো দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ অথবা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক মূল সংসদের পাশাপাশি আরেকটি ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক ফোরাম সৃষ্টি। বাংলাদেশে যেমন উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি ফোরাম হতে পারে এবং সংসদের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণে (যেমন বাজেট অনুমোদনে) এই ফোরামকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। কাজেই মূল আনুপাতিক পদ্ধতি বজায় রেখেও বিভিন্ন উপায়ে ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্ব অর্জন করা সম্ভব। আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।

উপসংহার

বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো অস্থিতিশীল। এই অস্থিতিশীলতার দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু স্বল্প মেয়াদেও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন এ অস্থিতিশীলতা প্রশমনে সহায়ক হতে পারে। এটা আশার কথা, কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই আবার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রশমনের লক্ষ্যে যেসব প্রস্তাব এযাবত্ করা হয়েছে, তার মধ্যে সরকারের মেয়াদ হ্রাস ও আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন প্রবর্তন সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল।

ইতিমধ্যে অনেকেই সরকারের মেয়াদ হ্রাসের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ফজলে হাসান আবেদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ পত্রপত্রিকার মাধ্যমে এ প্রস্তাবের পক্ষে তাঁদের মত ব্যক্ত করছেন। আশার কথা যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও ইতিমধ্যেই অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই সরকারের মেয়াদ হ্রাসের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন।

লক্ষ করা দরকার, মেয়াদ হ্রাসের প্রস্তাব বর্তমান সরকারের জন্য প্রযোজ্য নয়। এ সরকার পাঁচ বছর মেয়াদের জন্যই নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে ভবিষ্যত্ সরকারের মেয়াদ চার বছরে হ্রাস করা যেতে পারে।

একইভাবে আগামী নির্বাচনের আগে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে বিশ্বব্যাপী সমর্থন ক্রমেই বাড়ছে। এখন ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন অনুসৃত হচ্ছে। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ড সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচন পরিত্যাগ করে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন গ্রহণ করেছে। এমনকি খোদ যুক্তরাজ্যেও এখন আনুপাতিক পদ্ধতি সমাদৃত হচ্ছে। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের এসেম্বলি নির্বাচনে আনুপাতিক পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। যেসব শর্তের ভিত্তিতে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল ২০১০ সালের নির্বাচনের ফলে গঠিত রক্ষণশীল দলের সঙ্গে জোট সরকারে যোগ দিয়েছে, তার অন্যতম হলো আনুপাতিক পদ্ধতির আলোকে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার।

আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে বিশ্বব্যাপী সমর্থন বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশেও এর প্রতি সমর্থন বাড়ছে। নাজিম কামরান চৌধুরী, ব্যারিস্টার হারুন-অর-রশিদসহ আরও অনেকে পত্রপত্রিকায় এ পদ্ধতির পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের অনেক চিন্তাশীল নেতানেত্রী আনুপাতিক পদ্ধতির প্রতি তাঁদের সমর্থন ও সহানুভূতি ব্যক্ত করেছেন।

বাংলাদেশের জনগণ এক অর্থে আনুপাতিক পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্তই বটে। নির্বাচনে অনেক সময় তারা এলাকার সুনির্দিষ্ট প্রার্থীর বদলে দলের (‘মার্কা’র) পক্ষেই ভোট দেয়। কাজেই আনুপাতিক পদ্ধতির প্রবর্তন তাদের এই মনস্তত্ত্বের সঙ্গে বরং আরও সংগতিপূর্ণই হবে। যেটা প্রয়োজন তা হলো, একটা জাতীয়ভিত্তিক আলোচনা।

লক্ষণীয় যে করাল রাজনৈতিক বিভক্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতৈক্যে পৌঁছাতে পেরেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থার প্রবর্তন (এখন যদিও বাতিল), বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি তার উদাহরণ। কাজেই ধৈর্যসহকারে চেষ্টা করে গেলে সরকারের মেয়াদ হ্রাস ও আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন প্রবর্তনের বিষয়েও জাতীয় মতৈক্যে উপনীত হওয়া একেবারে অসম্ভব কি?

নির্দেশিত রচনাবলি

Abed, Fazle H. (1999), Interview, The Daily Star, Dhaka, April 9, 1999.

Choudhury, Nazim K. (2006) ‘The Constitution is Neither Bible Nor a Plaything’, The Daily Star, December 5.

Chowdhury, Sirajul Islam (2008), Interview, The Daily Star, Dhaka, November 18.

Islam, Nazrul (2008a), Can Proportional Representation Help Stabilize Democracy in Bangladesh? Journal of Bangladesh Studies, Vol. 10, No.2, pp, 52-68

Islam, Nazrul (2008b), Vital Reforms Ignored, The Daily Star, Dhaka, November 21

Islam, Nazrul (2008c), Looking Beyond 2008 Election, The Daily Star, Dhaka, December1.

Islam, Nazrul (2007) ‘Growing Our Way Out of Trouble,’ Forum, Vol. 2, Issue 6 (July), pp.1-7

Islam, Nazrul (2001), ‘The Institutional Approach to Political Stability in Bangladesh’, Jaurnal of Social Studies No. 93, July September, pp. 80-100

Islam, Nazrul (1999), Can We Stop Hartal By Reducing the Government Term?’ The Daily Star, Dhaka, November 9

Islam, Nazrul (1998), ‘An Idea to Reduce Hartal’, The Daily Star, Dhaka, April 9

ইসলাম, নজরুল (১৯৯৭), ‘আগামী দিনের বাংলাদেশ: নতুন সহস্রাব্দের সূচনায় স্বদেশ ভাবনা’, সমাজ নিরীক্ষণ, সংখ্যা ৬৪, পৃ. ৩৯-৫০

Rashid, Harun ar (2007), ‘The Case for Proportional Representation’, The Daily Star, Dhaka, November 6

Sobhan Rehman (1999), Interview, The Daily Star, April 9, 1999

টীকা

১. এ-সংক্রান্ত আরও আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: Islam (2007)

২. এ-সংক্রান্ত আরও আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: Islam (2008b, 2008

৩. লেখাটি শেষ করার পর জানা গেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে।

৪. এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ইস্যুগুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: Islam (1998, 1999) এবং বিশেষত Islam (2001)। এ বিষয়ে আলোচনার শুরুর জন্য দ্রষ্টব্য: ইসলাম (১৯৯৭)।

৫. এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ইস্যুগুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: Islam (2008)।

৬. ফজলে হাসান আবেদ ও রেহমান সোবহানের এ-সংক্রান্ত অভিমতের জন্য দ্রষ্টব্য: The Daily Star, April 9, 1999। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অভিমতের জন্য দ্রষ্টব্য: The Daily Star, November 18, 2008।

৭. সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অভিমতের জন্য দ্রষ্টব্য: The Daily Star, August 5, 2009|।

৮. নাজিম কামরান চৌধুরীর প্রাসঙ্গিক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য:Choudhury (2006)। ব্যারিস্টার হারুন রশীদের অভিমতের জন্য দ্রষ্টব্য:  Rashid (2007)।

* এ প্রবন্ধে প্রকাশিত অভিমতগুলো লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত এবং এসব অভিমতের সঙ্গে তিনি বর্তমানে যেসব সংস্থার সঙ্গে জড়িত, সেসবের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।